সিলেট: আযানের তখনো ২০ মিনিট বাকি। ইফতারের পসরা নিয়ে কয়েকজনের তোড়জোড় চলছে। তার আগেই সারি বেধেঁ বসে পড়ছে শত শত মানুষ। সাজিয়ে রাখা হয়েছে থালা। তাতে দেওয়া হয়েছে খিচুড়ি, ছোলা, মুড়ি, পেঁয়াজু, বেগুনি, তরমুজ, খেজুর আর জিলাপি। প্রতিটি থালার পাশে লাইন ধরে বসে পড়েছেন রোজাদাররা। মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে আজান ভেসে আসতেই শরবত পান করে শুরু হয় ইফতার।
সোমবার (১০ মার্চ) এই দৃশ্য সিলেটের হযরত শাহজালাল (রহ.) দরগা মসজিদ প্রাঙ্গণে। প্রায় ৭০০ বছরের ঐতিহ্য গণ-ইফতারের আয়োজন এভাবেই পালন হয়ে আসছে। ৩৬০ আউলিয়ার শাহজালাল মাজারে মুসাফির, পথচারী, ছিন্নমূল, শ্রমজীবী ও চাকরিজীবীসহ নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ এই ইফতারে যোগ দেন। একইসঙ্গে কোনো ভেদাভেদ ছাড়া ইফতার করেন তারা। এ যেন সৌহার্দ্যের এক অনন্য উদাহরণ। প্রতিদিন শত শত মানুষ এখানে ইফতারে শামিল হন। প্রতিবছরই প্রথম রমজান থেকে শুরু হয় এই গণ-ইফতার কর্মসূচি।
সুদূর ইয়েমেন থেকে ইসলামের আলোকরশ্মি ছড়াতে ৩৬০ সঙ্গী নিয়ে সাড়ে ৭০০ বছর আগে সিলেট অঞ্চলে আসেন হযরত শাহজালাল (র.)। সিলেটে গড়ে তোলেন আস্তানা। আর সে সময় থেকেই তিনি প্রতি বছর রমজানে ভক্ত আশেকানদের নিয়ে ইফতারের প্রচলন শুরু করেন। সেই ঐতিহ্য আজও চলমান।

মুসাফির, পথচারী, ছিন্নমূল, শ্রমজীবী ও চাকরিজীবীসহ নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ এই ইফতারে যোগ দেন
জানা যায়, ভক্তকুল ও মাজার কর্তৃপক্ষের টাকায় শাহজালাল মাজারে প্রতিদিন তিন শতাধিক রোজাদারকে ইফতার করানো হয়। গণ-ইফতারে অংশ নিয়ে তৃপ্ত হন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সাধারণ মানুষ। শুধু মুসাফির আর ভবঘুরে নয়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঘুরতে আসা অনেক রোজাদাররা ইফতার করেন এখানে। এভাবে বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে গণ-ইফতারের এই ঐতিহ্য, যা সিলেটসহ সারাদেশের মানুষের হৃদয়ে এক বিশেষ স্থান করে নিয়েছে।
ঢাকার নরসিংদী থেকে আসা কাপড় ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন বলেন, ‘ব্যবসার কাজে সিলেট এসেছি, দরগায় এসেছি নামাজ আদায়ের জন্য। মাজারে ইফতারে শরীক হয়ে অনেক প্রশান্তি ও তৃপ্তি পেয়েছি। অনেক আনন্দ লেগেছে এখানে ইফতার করে।’
ইফতার করতে আসা চাকরিজীবী পারভেজ বলেন, ‘সিলেটে চাকরির সুবাদে প্রায় মাজারে ইফতার করতে আসি। এখানে বসে শত শত মানুষের সাথে ইফতার করলে হৃদয় ছুয়ে যায়, অন্যরকম এক প্রশান্তি কাজ করে দেহের ভিতর। মনটা হাল্কা লাগে তাই ইচ্ছে করেই এখানে ইফতার করতে আসি।’
মাজার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, হযরত শাহজালালের মাজারে দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানত নিয়ে আসা ভক্তদের ও মুসাফিরদের সুবিধার জন্যই এ গণ-ইফতারের আয়োজন করা হয়। তাদের দান আর মাজার কর্তৃপক্ষের টাকায় চলে আসা এ আয়োজনে প্রতিদিন শত শত ধনী-গরীব এক কাতারে বসে ইফতার করেন।’
হযরত শাহজালাল (র.) মাজারের খাদেম ষাটোর্ধ্ব শামুন মাহমুদ খান বলেন, ‘গণ-ইফতারের এ ঐতিহ্য সাড়ে ৭০০ বছর ধরে চলে আসছে। আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। মসজিদে ইফতারির আয়োজন করা হতো। মহল্লার বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকেও ইফতারি পাঠানো হতো। হজরত শাহজালাল (রহ.) মাজারে এই ইফতার আয়োজন শুধু একটি খাবার গ্রহণের অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি মানবিকতা ও সম্প্রীতির এক অনন্য উদাহরণ।’
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শত শত মানুষ এখানে ইফতারের অংশ নেন, যা ইসলামের শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে। উঁচু নিচু সব শ্রেণির মানুষ এক কাতারে ইফতারের এমন দৃশ্য মনে করিয়ে দেয় ইসলামে কোনো ভেদাভেদ নেই। এবং এ বছর থেকে সাহরিরও আয়োজন করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।