শিশুকে ধর্ষণের পর খুন
৩ বছরেও মেলেনি ডিএনএ রিপোর্ট, বিচার মিলবে কবে?
১১ মার্চ ২০২৫ ১৯:৫০
চট্টগ্রাম ব্যুরো: প্রায় তিন বছর পার হলেও চট্টগ্রাম নগরীতে ধর্ষণের পর খুন হওয়া শিশু মারজানা হক বর্ষার (৭) মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) আদালতে জমা দিতে পারেনি পুলিশ। বর্ষার পরিবারের দাবি, ডিএনএ রিপোর্ট না আসায় চার্জশিট জমা দিতে পারছে না পুলিশ।
মঙ্গলবার (১১ মার্চ) বেলা ১২ টার দিকে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের এস রহমান হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান শিশু বর্ষার পরিবার। দ্রুত বর্ষা হত্যা মামলার চার্জশিট দেওয়ার দাবিতে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
২০২২ সালের ২৪ অক্টোবর নগরীর জামালখান এলাকায় চিপস কেনার জন্য বাসা থেকে দোকানের উদ্দেশে বের হয়ে নিখোঁজ হন কুসুমকুমারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী মারজানা হক বর্ষা। নিখোঁজের তিনদিন পর জামালখান সিকদার হোটেলের পেছনের একটি নালা থেকে বস্তাভর্তি শিশু বর্ষার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। বর্ষা হত্যায় জড়িত থাকার অপরাধে লক্ষণ দাশ নামে এক দোকান কর্মচারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে লক্ষণ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছিল।
সংবাদ সম্মেলনে শিশু বর্ষার মা ঝর্না বেগম বলেন, ‘আমার আদরের সাত বছরের শিশু সন্তান বর্ষাকে তিন বছর আগে ধর্ষণ, এরপর হত্যা করে লাশ বস্তায় বেঁধে নালায় ফেলে দেওয়া হয়। আসামি ধরা পড়ছে আজ তিন বছর হতে চলল। চার্জশিট না দেওয়ায় এখনও বিচারই শুরু হয়নি। তিন বছরেও কেন চার্জশিট হবে না ? কবে বিচার শুরু হবে? আদৌ বিচার পাব কিনা, জানি না। আমার সন্তানের ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চাই।’
বর্ষার বোন সালেহা আক্তার রুবি বলেন , ‘গত তিন বছর ধরে আমার বোনের মামলাটি চলছে। আসলে চলছে বললে ভুল হবে। সেটা থানায় ফাইল হিসেবে আটকে আছে। ২০২২-২৩ সালের দিকে আমাদের ওপর প্রভাবশালীদের চাপ ছিল। বর্তমানে সেগুলো আর নেই। কারণ সেসব প্রভাবশালী এখন নেই। আর থানা থেকে চাপের শিকার না হলেও প্রত্যেক মাসে হয়রানি করেছে। প্রত্যেক মাসে আমরা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে গেলে তিনি শুধু আমাদের একটাই কথা বলেন, যে ডিএনএ রিপোর্ট না আসা ছাড়া তাদের কিছু করার নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত ডিএনএ রিপোর্ট না আসবে তারা কিছুই করতে পারবে না।’
‘এই ডিএনএ রিপোর্ট নিয়ে আমরা একই জায়গায় থেমে আছি। মামলার প্রথমেই রয়ে গেছি। এটার কোনো রকম কিছু হয়নি। এটা আদালতেও উঠেনি এখন পর্যন্ত। আমাদের দাবি যত দ্রুত সম্ভব মামলাটি আদালতে তোলে শুরু করা হয়। আমার মা-বাবাও আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারছে না। গত তিন বছর ধরে আমরা হেনস্থার শিকার হচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশের কাছে বারবার যাচ্ছি। তারা বিরক্ত হচ্ছে। তারাও আমাদের প্রতি এক প্রকার অনীহা দেখাচ্ছে। আমাদেরও একটি বিরক্তি চলে আসছে, যে মামলাটি আর আমরা কন্টিনিউ করব কিনা। কারণ, এটা কত বছর লাগবে তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না। তাই আমরা চাই দ্রুত ডিএনএর রিপোর্ট যাতে আসে। অন্তত যাতে মামলাটি আদালতে তোলা যায়।’
প্রভাবশালী কারা চাপ দিয়েছিলেন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে রুবি বলেন, ‘আমাদের এলাকার যিনি কাউন্সিলর (শৈবাল দাশ সুমন) ছিলেন তিনি অনেকভাবেই চাপ দিয়েছিলেন। তিনি আমাদের বলেছিলেন, মামলা মামলার মতো চলবে। কিন্তু আমরা যেন খোলাসাভাবে না আসি, গুটিয়ে থাকি। আমাদের কথা বলা তিনি পছন্দ করতেন না। আমার আম্মুকে বলেছে, আপনার এক মেয়ে তো মারা গেছে, বাকি চার মেয়েকে নিয়ে যাতে ভালো থাকতে পারেন সে ব্যবস্থা করেন। এভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে আমার আম্মু বিষয়টি থেকে পিছিয়ে আসে।’
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে চট্টগ্রাম ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পুষ্পিতা নাথ বলেন, ‘আসামির স্বীকারোক্তির পর বর্ষার পরিবারের প্রত্যাশা ছিল তারা দ্রুত ও সুষ্ঠু বিচার পাবেন। কিন্তু গত তিন বছর বর্ষার পরিবার বিচার দূরে থাকুক, এখনও মামলার কোনো অগ্রগতিরই মুখ দেখতে পায়নি। তদন্তকারী পুলিশ মামলাটির চার্জশিটই দিতে পারেনি। এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও নানা অজুহাতে পরিবারের সদস্যদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আইনজীবীদের অভিমত, ধর্ষণ মামলার বিচারপ্রক্রিয়ায় ডিএনএ রিপোর্ট বাধ্যতামূলক করা হলেও, চার্জশিট দিতে ডিএনএ রিপোর্ট প্রয়োজন নেই। আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর ভিত্তিতেই এ মামলায় পুলিশ চার্জশিট দিতে পারতো। ডিএনএ রিপোর্ট না আসাকে অজুহাত দেখিয়ে চার্জশিট না দেওয়া তদন্তকারী কর্মকর্তার দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ছাড়া কিছু নয়।’
সংবাদ সম্মেলনে বর্ষার পরিবার ও শিক্ষার্থীরা প্রধান উপদেষ্টা বরাবর চার দফা দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলো হলো- অবিলম্বে শিশু বর্ষা ধর্ষণ ও হত্যা মামলার চার্জশিট ও আগামী একমাসের মধ্যে ডিএনএ রিপোর্ট দিতে হবে, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, হত্যাকাণ্ড ও নারীর প্রতি সহিংসতার সঙ্গে জড়িত অপরাধীর দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষণ, নিপীড়ন বন্ধ ও বিচারে ব্যর্থ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে অবিলম্বে অপসারণ করতে হবে। বিভাগীয় পর্যায়ে পর্যান্ত, মানসম্মত পূর্নাঙ্গ ডিএনএ ল্যাব স্থাপন করতে হবে এবং ধর্ষণ মামলায় নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি আধুনিকায়ন করতে হবে।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন শিশু মারজানা হক বর্ষার বোন আয়েশা, ফাতেমা, মামা আলি হোসেন, নারীমুক্তি কেন্দ্র, চট্টগ্রামের আহবায়ক আসমা আক্তার, চট্টগ্রাম আইন কলেজের শিক্ষার্থী সাদিয়া আফরিন, হামিদ উদ্দিন, আব্দুল আল জাওয়াদ ও আরিফুল রহমান সবুজ।
সারাবাংলা/আইসি/পিটিএম