আনন্দাশ্রু নিয়ে বাড়ি ফিরল মুক্তামনি
২২ ডিসেম্বর ২০১৭ ১২:২৮
জাকিয়া আহেমদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
ভোর ছয়টা। ঢামেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের নির্ধারিত কেবিনে গিয়ে দেখা যায়, কেবিন জুড়ে চারটি ব্যাগ, একটি সাদা প্লাস্টিকের বস্তা, কয়েকটি বালিশ একসঙ্গে বাঁধা, এখানে সেখানে আরও নানা কিছু। আর কেবিনের মানুষগুলো অপেক্ষা করছেন একটি অ্যাম্বুলেন্সের জন্য। পরিবার, আত্মীয়-স্বজনের অপেক্ষার পালা শেষ করে সন্ধ্যা ৭টার দিকে সাতক্ষীরার বাড়িতে পৌঁছায় মুক্তামনি।
যে মুক্তামনিকে এখন পুরো দেশ চেনে, যার চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যাকে দেখতে এই কেবিনে এসেছিলেন ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম আর যার চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করেছির সিঙ্গাপুরের উন্নত হাসপাতাল।
https://youtu.be/lXI4TiPoLIE
কিন্তু সিঙ্গাপুরের হাসপাতাল অপারগতা প্রকাশ করলেও হাল ছাড়েননি এই বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের চিকিৎসকরা। তারা যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছেন, চিকিৎসা শুরু করেছেন। তব চিকিৎসার শুরুতে আশঙ্কা ছিল ১১ বছরের এই মেয়েটির আক্রান্ত ডান হাত অক্ষত রেখে রাখতে পারবেন তারা নাকি হাতটি কেটে ফেলতে হবে। হয়নি-ডান হাত রেখেই তারা হাতের প্রায় সাড়ে তিন কেজি অতিরিক্ত মাংসপিণ্ড কেটে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। পোকা ধরা সেই হাতটি এখন প্রেশার ব্যান্ডেজ দিয়ে বাঁধা, চিকিৎসকরা আশা করছেন, ধীরে ধীরে হাতের ফোলা ভাব কমে আসবে, সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে মুক্তামনি।
সেই মুক্তামনি আজ ২২ ডিসেম্বর ভোরে ১৬৪ দিন পর বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়। সঙ্গে বাবা ইব্রাহিম হোসেন, মা আসমা খাতুন ও দেড় বছর বয়সী ছোট ভাই আলআমিন। আর নিজের কেবিন থেকে বের হবার পর প্রায় প্রতিটি কেবিনের সামনেই থাকতে হয় তাকে। এখানকার প্রতিটি কেবিনে থাকা রোগী ও স্বজনদের থেকে বিদায় নেয়, হাসপাতালে থেকে থেকে যে তারা একে অন্যের স্বজন হয়ে গিয়েছিল। মুক্তামনি তাদের থেকে বিদায় নেয়, দোয়া নেয়। সবার চোখের কোনেই তখন জল চিকচিক করে, তবে এটা হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার আনন্দ, এটা আনন্দাশ্রু।
গতকাল ২১ ডিসেম্বর হাসপাতাল থেকে মুক্তামনিকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। তবে সম্পূর্ণ চিকিৎসা শেষ না হওয়াতে তাকে আবার একমাস পর হাসপাতালে আসতে বলা হয়েছে। জানতে চাইলে গতকাল ২১ ডিসেম্বর ডা. সামন্ত লাল সেন সারাবাংলাকে বলেন, ছোট মেয়েটি হাসপাতালে থেকে, ছুড়ি কাচির নিচে পরে মন খারাপ করে থাকতো, বাড়ি যেতে চাইতো। যেহেতু ওর চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি তাই ওকে বাড়ি ঘুরে আসার জন্য রিলিজ দেওয়া হলো। বাড়ি ঘুরে এলে ওর মনটা ভালো হবে, কিন্তু আমরা ওকে পর্যবেক্ষণে রাখবো, ওরা পরিবারকে সেভাবেই বলা হয়েছে। কোনও সমস্যা হলে তারা তখনি চলে আসবে।
সমস্যা হবার সম্ভাবনা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আশা করছি কোনও সমস্যা হবে না। একমাস পর ফেরত এলে আমরা আমাদের পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে বলতে পারবো, তবে মুক্তামনিকে নিয়ে আমাদের বহুদূর যেতে হবে, সহসাই ও একেবারে সুস্থ হয়ে যাবে এটা আমরা বলতে পারছি না।
আজ ২২ ডিসেম্বর মুক্তামনির কেবিনে থাকা অবস্থাতেই এ প্রতিবেদককে ফোন করেন ডা. সামন্ত লাল সেন। মুক্তামনির বাবা ইব্রাহিম হোসেন ও মুক্তামনির সঙ্গেও ফোনে কথা বলেন তিনি। তবে এ সময় ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা ডা. সেন এবং মুক্তামনির বাবা দুজনই আবেগ আপ্লুত হয়ে যান। ডা. সেন মুক্তামনির বাবাকে বলেন, কোনও চিন্তা করবেন না, কোনও সময়ে কোনও অসুবিধা হলে আমাকে জানাবেন।
এসময় তিনি মুক্তামনির সঙ্গে কথা বলতে চাইলে মোবাইল ফোন ধরেই মুক্তামনি তাকে স্যার ভালো আছেন জানতে চাইলে কেঁদে দেন ডা. সামন্ত লাল সেন। ডা. সেন মুক্তামনিকে বলেন, তুমি একমাস পর আবার আসবে আমাদের কাছে। তুমি কোনও চিন্তা করো না, তুমি ভালো থাকবে-আর কোনও অসুবিধা হলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবে।
আর মুক্তামনি সারাবাংলাকে জানায়, আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন। আমি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতে চাই, তিনি আমার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, চিকিৎসকদের কাছে সবসময় আমার খোঁজ নিয়েছেন, আমি ধন্যবাদ দিতে চাই আমার চিকিৎসকদের। তারা আমার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন আমার হাতটাকে ভালো করে দেওয়ার জন্য।
বাড়ি যেতে পারে আনন্দ লাগছে কিনা জানতে চাইলে সে জানায়,বাড়ি গিয়ে সবাইকে দেখবো। এই হাসপাতালে ছয়টা মাস কাটাইছি। বাড়ি গিয়ে এবার সবাইকে দেখতে চাই, তাতেই আমার আনন্দ।
এদিকে, হাসপাতাল ছাড়ার আগে প্রধানমন্ত্রীসহ চিকিৎসকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন মুক্তামনির পুরো পরিবার। মুক্তামনির বাবা ইব্রাহিম হোসেন বলেন, চিকিৎসকরা আমাদের জন্য কী যে করেছেন সেটা নিজের চোখে দেখেছি, আমার মেয়ের জন্য তারা এতদিন সংগ্রাম করেছেন। আজ বাড়ি যাবার সময়েও তারাই এগিয়ে এলেন। আমার আম্মুজানের (মুক্তামনি) সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া না হওয়া আল্লাহর হাতে। কিন্তু এই চিকিৎসকরা আমার মেয়ের জন্য যা করলেন তাতে আমি তাঁদের কাছে চির কৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম।
সারাবাংলা/জেএ/এমএম