‘গাজায় যুদ্ধবিরতির নামে পুরোটাই ছিল রাজনৈতিক কৌশল’
১৯ মার্চ ২০২৫ ২০:৫৯
গাজা উপত্যকায় ফের জোরালো হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল। হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে ২৪ ঘণ্টার কম সময়ে অন্তত ৪০০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গত ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর গাজায় এটিই সবচেয়ে বড় বিমান হামলা। এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধবিরতি বাড়ানোর আলোচনা সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া যুদ্ধে গত ১৫ মাস ধরে ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় ৪৮ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। গাজাবাসীর মধ্যে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছিল চলতি বছরের যুদ্ধবিরতি। ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করেছিলেন তারা। কিন্তু যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরামর্শ করে নতুন করে গাজায় হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার।
মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) গার্ডিয়ানে একজন স্বাধীন সাংবাদিক ফিলিস্তিনি-ইসরায়েলিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ডালিয়া হাতুকা জানান, ফিলিস্তিনি-ইসরায়েলি বিষয় পর্যবেক্ষণকারীরা জানতেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কাতার এবং মিশরের নেতৃত্বে কয়েক মাস ধরে আলোচনার পরেও যুদ্ধবিরতির অর্থ কখনই অবরুদ্ধ উপকূলীয় অঞ্চলে ইসরায়েলের আক্রমণ বন্ধ করা হয়নি।
ডালিয়া হাতুকা গার্ডিয়ানের মতামত প্রবন্ধে লিখেন, জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুসারে, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২২ জানুয়ারি থেকে ১১ মার্চে অর্থাৎ যুদ্ধবিরতির মধ্যে কমপক্ষে ৭০০ ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন অথবা তাদের মৃতদেহ এমন এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে যেখানে চিকিৎসকরা আগে যেতে পারতেন না।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, গত দুই মাসে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির শর্তাবলীও লঙ্ঘন করেছে। তীব্র ঠান্ডা থেকে রক্ষা পেতে লোকজনকে আশ্রয় নিতে তাঁবু ও ট্রেলার রাখার অনুমতি দেয়নি। যার ফলে বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে, বিশেষ করে শিশুরা।

ফিলিস্তিনি-ইসরায়েলিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ডালিয়া হাতুকা
যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে বলা হয়েছিল, ধ্বংসস্তূপ অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য ইসরায়েল ভারী যন্ত্রপাতি গাজায় প্রবেশের অনুমতি দেবে। কিন্তু তারা তা করেনি। জাতিসংঘ বলেছে, ইসরায়েল যদি বর্তমান অবরোধ প্রত্যাহার না করে তবে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িঘর এবং অবকাঠামো পরিষ্কার করতে এবং পুনর্নির্মাণ শুরু করতে ৩৫০ বছর সময় লাগবে।
চুক্তির আরেকটি শর্ত ছিল, গাজায় আরও ত্রাণ সরবরাহের অনুমতি দেওয়া। যদিও চুক্তির প্রাথমিক পর্যায়ে আরও বেশি সরবরাহ ট্রাক প্রবেশ করেছিল। বিবিসির এক প্রতিবেদন অনুসারে, যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম পর্যায়ের মেয়াদ শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরে ২ মার্চ, ইসরায়েল গাজায় সমস্ত ত্রাণ সরবরাহের প্রবেশ বন্ধ করে দেয় এবং একই সঙ্গে ড্রোন হামলা চালায়।
জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ইসরায়েল কাঁচি থেকে শুরু করে জেনারেটর, খেলনা এবং মশলা পর্যন্ত সবকিছুর প্রবেশে নিয়মতান্ত্রিকভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আসছিল। কিন্তু খাদ্য, জ্বালানি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ার ফলে, মানবিক সংস্থাগুলি আশঙ্কা করছে, গাজা ‘তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার বিপর্যয়কর স্তরের মুখোমুখি হচ্ছে’।
ডালিয়া হাতুকা বলেন, তথাকথিত যুদ্ধবিরতি ছিল একটি রাজনৈতিক কৌশল। এই চুক্তিই মধ্য দিয়ে ইসরায়েল যুদ্ধের সময়সূচি পুনর্নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। ইসরায়েল গাজার ওপর ক্রমাগত অবরোধ, বিমান হামলা এবং ফিলিস্তিনি বন্দিদের হত্যা ও নির্যাতনের মাধ্যমে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিম তীরে একটি সমান্তরাল যুদ্ধ চলছে, যেখানে ইসরায়েলি বাহিনী ফিলিস্তিনিদের বাড়িতে অভিযান চালাচ্ছে, হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে এবং হাজার হাজার মানুষকে আটক করছে।
এটি এমন একটি নমুনা যা আমরা আগেও দেখেছি। ইসরায়েলি আক্রমণ, বেসামরিক নাগরিকদের ক্রমবর্ধমান মৃত্যু, বিশ্বব্যাপী ক্ষোভের ফলে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়। তারপর একটি সংক্ষিপ্ত উত্তেজনা হ্রাস পায়। কিন্তু সেই সময়ের মধ্যে ইসরায়েল তার সামরিক অবস্থানগুলোকে আরও শক্তিশালী করে। পুনরায় অস্ত্র সরবরাহ করে এবং আরেক দফা সহিংসতার জন্য মঞ্চ তৈরি করে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০০৮-০৯ সালে অপারেশন কাস্ট লিড। পরে ছয় মাসের যুদ্ধবিরতি, তারপর শুরু হয়েছিল ইসরায়েলের ২৩ দিনের ভয়াবহ আক্রমণ। সে সময় তারা একইভাবে দাবি করে যে হামাস যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। তবে, প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে ইসরায়েল কয়েক মাস আগে থেকেই আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিল। যুদ্ধবিরতিকে তারা ব্যবহার করে সামরিক প্রস্তুতির জন্য।
আন্তর্জাতিক তদন্ত তীব্র হলে ইসরায়েল প্রায়শই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের যুক্তিসঙ্গত পক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করে এবং সহিংসতা পুনরায় শুরু হলে ফিলিস্তিনিদের ওপর দোষ চাপায়। দখলদারিত্ব এবং অবরোধের বিষয়টি সমাধান না করে যুদ্ধবিরতি আলোচনায় অংশগ্রহণ করে। ফলে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান বাধাগ্রস্ত হয়।
একটি প্রকৃত যুদ্ধবিরতির জন্য ইসরায়েলের চলমান দখলদারিত্ব এবং গাজার ওপর শ্বাসরুদ্ধকর অবরোধের অবসান প্রয়োজন। কেবল সহিংসতার একটি সাময়িক বিরতি নয়। ততক্ষণ পর্যন্ত, যেকোনো তথাকথিত যুদ্ধবিরতি একটি কৌশল হয়ে থাকবে।
ডালিয়া হাতুকা মনে করেন গাজার প্রয়োজন আরেকটি ক্ষণস্থায়ী যুদ্ধবিরতি নয়, বরং আন্তর্জাতিক নীতিতে একটি মৌলিক পরিবর্তন। ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে নিন্দার ঊর্ধ্বে বিবেচনা করা বন্ধ করে মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের জন্য তাদের জবাবদিহি করতে হবে। এর চেয়ে কম কিছু নিশ্চিত করবে যে সহিংসতার এই চক্র অব্যাহত থাকবে। যার ফলে গাজার জনগণ এবং সামগ্রিকভাবে ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি হবে।
সারাবাংলা/এইচআই