চ্যালেঞ্জিং, তবুও প্রবাসীদের ‘প্রক্সি ভোটিং’ নিয়ে ভাবছে ইসি
২০ মার্চ ২০২৫ ২২:২১ | আপডেট: ২০ মার্চ ২০২৫ ২২:২২
ঢাকা: ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসছে ডিসেম্বর হতে পারে— এমন সম্ভাবনাকে সামনে রেখে এরই মধ্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে কেএমএম নাসির উদ্দিন কমিশন। যদিও ইসির জন্য নির্বাচন সংস্কার কমিশনের মতামত এখনো আসেনি। তবে ইসির নিজস্ব পরিকল্পনা থেকেই এবার প্রবাসী ভোটারদের নির্বাচনে অন্তর্ভুক্ত করতে চাচ্ছে। আর এই অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতে তিনটি বিকল্প পদ্ধতি নিয়ে ভাবছে নির্বাচন কমিশন। সেগুলো হলো- পোস্টাল ব্যালট, অনলাইন ও প্রক্সি ভোটিং পদ্ধতি।
সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ গণমাধ্যমকে জানান, সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হলে প্রক্সি ভোট পদ্ধতিটি মোটামুটি পরিসরে আর বাকি দুটি পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়ন করার কথা ভাবছে কমিশন। যদিও নির্বাচন বিশেষজ্ঞর বলছেন, প্রবাসীদের ভোট সংগ্রহ বেশ চ্যালেঞ্জিং। তাই ইসিকে রিস্ক বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে কাজ এগিয়ে নিতে হবে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে ২০০৮ সালে যুক্ত করা হয় পোস্টাল ব্যালট। এ পদ্ধতিতে নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত এবং কারাবন্দিরা ভোট দিতে পারলেও পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে এ পর্যন্ত প্রবাসী বাংলাদেশিরা ভোট দিতে পারেনি।’ তাই আগামী নির্বাচনে প্রবাসীদের আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে পোস্টাল ব্যালটের পরিবর্তে প্রক্সি ভোটকে উপযুক্ত মনে করছেন তিনি।
তবে এই পদ্ধতিতে বড় সমস্যা হলো- যিনি দেশে প্রক্সি ভোট দিচ্ছেন তিনি প্রবাসীর পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিচ্ছেন কিনা। আব্দুল আলীম বলেন, ‘আমাদের দেশে একই ফ্যামিলিতে একজন এক্স পার্টি করে, আরেকজন ওয়াই পার্টি করে, বা একজন এক্স পার্টির সমর্থক, আরেকজন ওয়াই পার্টির সমর্থক। এখন যে ভদ্রলোক এক্সপার্টির সমর্থক, সে তার ভাই ওয়াই পার্টির সমর্থক বা ফ্যামিলির কাউকে প্রক্সি নিয়োগ করল। সে হয়তো ভোট দিয়ে দিল ওয়াই পার্টিকে। তাকে এটা নিতে হবে, অন্য কোনো অপশন নেই। এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। তবে কারিগরি দিক থেকে প্রক্সি ভোটিং নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা নেই।’
এদিকে ইসির এই পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানালেও বেশ চ্যালেঞ্জিং বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আব্দুর রাজ্জাক। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণির মানুষ যারা বিদেশে আছেন তারা প্রচণ্ড পরিশ্রম করছেন এবং তাদের কষ্টার্জিত টাকা পাঠানোর মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। তাই ভোটিং রাইটস তাদের থাকা দরকার। তাদের জন্য কার্যকর পদ্ধতি নিয়ে কাজ করতে হবে।’
ঢাবির এ অধ্যাপক বলেন, ‘প্রক্সি যিনি দেবেন তিনি নিশ্চয়ই পাঁচজনের জন্য নয়, একজনের জন্য প্রক্সি হবেন। সেইসঙ্গে এক জেলার অধিবাসী কি অন্য জেলার প্রক্সি ভোটার হতে পারবেন? বা ঢাকা যিনি আছেন তিনি কি রংপুর এ ভোট দেবেন? এসব বিষয়ে বিবেচনায় রেখে কাজ করতে হবে।’ প্রক্সি নির্বাচন পদ্ধতিটা যেন ফেয়ার হয় এবং প্রবাসীরা যেন ইচ্ছেমতো তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন সেই ব্যবস্থা করতে হবে বলে মনে করেনি তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে যেন থার্ড কোনো পার্টি, থার্ড কোনো এনটিটি এসে ঠিক করতে না পারে যে, এই ৫০ জনের প্রক্সি হবেন উনারা- এ জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা আমরা দেব, করব। এটির মাধ্যমে আরেকটা কো-হোর্টিং যেন না হয়। সেটি হওয়ার সম্ভাবনা যেসব পদ্ধতিতে আছে, সেই ব্যাকডোরগুলো বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় টেকনিক্যাল সাপোর্ট প্রয়োগ করতে হবে।’
আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে আমাদের ইমপ্লিমেন্টেশনের পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া, টেকনিক্যাল কমিটিতে যারা কাজ করবেন তাদের সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে বিষয়টা মেইনটেইন করতে হবে। যে টিম টেকনিক্যাল বিষয়গুলো হ্যান্ডেল করবে সেই টিম যেন সত্যিকার অর্থে একটা কমপ্রিহেনসিভ টিম হয়।’
ঢাবির এই অধ্যাপক বলেন, ‘প্রক্সি যে ভোট হবে এর যেন একটা ভেরিফিকেশন প্রসেস থাকে। একটি গ্রহণযোগ্য প্রক্সি ম্যাপিং সিস্টেম তৈরি করতে হবে। কারণ, সংখ্যা কিন্তু অনেক। কোটি ভোটার যদি ইমপ্লিমেন্টেশনে যায় তাহলে অনেক অংক কিন্তু পরিবর্তন হবে। প্রবাসী ভোটারদের সেই ক্যাপাসিটি কিন্তু আছে। এ জন্য যথোপযুক্ত প্রক্রিয়া মেনটেইন করে সামনে এগোতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রক্সি ভোটার ভালো অপশন। তবে অনেক লিমিটেশন আছে। মাল্টিপুল স্টেজ পার হয়েই যেন সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। ইসি যে অ্যাপ তৈরি করছে তাতে রোবাস্ট আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম থাকা প্রয়োজন। ধরুন মার্চ প্রক্সি ভোটার ঠিক করলেন, কিন্তু তিনি যদি ভোটের সময় বেঁচে না থাকেন তখন বিষয়টা কী হবে- সেটা ঠিক করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সেইসঙ্গে এইটাও দেখার বিষয় আছে যে, তিনি আদৌ বিদেশে আছেন কিনা? আর কিছু হলে কমপ্লেইন করার সুযোগ রাখতে হবে এই অ্যাপে। এসব বিষয়ে আগে নিশ্চিত হতে হবে।’
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমাদের টেকনোলজি অনেক ম্যাচিউরড। কিন্তু যারা এটি ডেভলপ করবেন তাদের সঠিক ও সচেতনভাবে গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করতে হবে। সেইসঙ্গে এই টেকনিক্যাল কমিটির ওপর সুপারভিশন কমিটি এবং এর পর থাকবে আরেকটি মনিটরিং কমিটি। এককথায় মাল্টিপল লেবেলে এই কাজটি ফিল্টার করতে হবে।’
প্রবাসী ভোটারের ক্ষেত্রে পোস্টাল ব্যবস্থাকে আর যুগোপযোগী মনে করছেন না এই দুই বিশেষজ্ঞ। তাদের পরামর্শ, ভালো হয় প্রবাসী নিজেই অনলাইনে ভোট দিতে পারবেন- এমন ব্যবস্থার দিয়ে এগিয়ে যাওয়া। তাদের পরামর্শ ইসিকে অনলাইন ভোটিং ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যেতে হবে। ভোটার সমীকরণে প্রবাসীদের জন্য যে পদ্ধতি গ্রহণ করা হোক না কেন সেইটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাই রক্ষক যেন ভক্ষক না হয় সেজন্য সচেতন থাকার পরামর্শ এই দুই বিশেষজ্ঞের।
ইসির পদক্ষেপ
ইসি জানিয়েছে, প্রক্সি ভোটের জন্য আগামী ৮ বা ৯ এপ্রিলের মধ্যে একটা কর্মশালা হবে। সেখানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউটকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং এমআইএসটিকে সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর বাইরেও যেকোনো প্রতিষ্ঠান এ কাজে সহায়তা করতে পারে। নির্বাচন সংস্কার কমিশনের বিশেষজ্ঞদেরও আমন্ত্রণ জানাবে ইসি। এ ছাড়া, একটি সিস্টেম আর্কিটেকচার ডেভেলপের জন্য ইসির সাবেক অভিজ্ঞ কর্মকর্তা এবং এনজিওকেও আমন্ত্রণ জানানো হবে।
ইসির কারিগরি টিম
প্রক্সি ভোটের জন্য বিশেষজ্ঞ টিমের পাশাপাশি ইসির পক্ষ থেকেও একটি অ্যাপ তৈরি করা হবে। অ্যাপের মাধ্যমে প্রবাসী ভোটাররা ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য আবেদন করবেন। এর পর প্রবাসী ভোটার যাকে ভোট দেওয়ার জন্য মনোনীত করবেন অ্যাপে তার ভেরিফিকেশন লাগবে। জানা গেছে, সব আলোচনা শেষে যদি এই সিস্টেম গ্রহণযোগ্য হয় তখন ইসি একটি সিস্টেম ডেভেলপ করবে। পরে টেস্টিং ও অডিটিং হবে। আনতে হবে আইনের পরিবর্তন। এর পর ফাইনাল ট্রায়ালে যাবে এই পদ্ধতিটি।
সারাবাংলা/এনএল/পিটিএম
অনলাইন নির্বাচন কমিশন পোস্টাল ব্যালট প্রক্সি ভোটিং প্রবাসী ভোটার