আ.লীগ ইস্যুতে বিএনপি নেতাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য, অস্বস্তিতে কর্মীরা
২২ মার্চ ২০২৫ ২২:৪০
ঢাকা: রাজনীতির মাঠে প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে বিএনপি নেতাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে বিব্রত দলটির মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে যখন এনসিপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন মাঠ গরম করছে, ঠিক তখন বিএনপির শীর্ষ নেতারা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।
গত ২৪ ঘণ্টায় বিএনপির নীতিনির্ধরণী পর্যায় থেকে মধ্যম সারির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের ইস্যুতে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তা রীতমতো পরস্পরবিরোধী। এ ছাড়া, গত সাত মাসে আওয়ামী লীগ ইস্যুতে দেওয়া বিএনপি নেতাদের বক্তব্যের মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না। কেউ আওয়ামী লীগের রাজনীতির ব্যাপারে উদার মনোভাব পোষণ করছেন, কেউ খুবই কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। কেউ আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে বলছেন, কেউবা আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে বলেছেন। অবশ্য কেউ কেউ আবার মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন।
দলের শীর্ষ নেতাদের এ ধরনের পরস্পরবিরোধী অবস্থানে মাঠ ও তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা তাদের করণীয় ঠিক করতে পারছেন না। স্থানীয় রাজনীতিতে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে কীভাবে মোকাবিলা করবেন, সে ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন তারা।
গত ২৪ ঘণ্টায় বিএনপি নেতারা যা বললেন
শুক্রবার (২১ মার্চ) সন্ধ্যায় নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী রেলস্টেশন চত্বরে এক গণইফতার কর্মসূচিতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘বিএনপি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। প্রত্যেক মানুষের রাজনীতি করার অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশের প্রত্যেক ব্যক্তি তার সংগঠন করতে পারবে। আমরা প্রত্যেক ব্যক্তির সংগঠন করার অধিকারে বিশ্বাস করি। বর্তমান সরকার নির্ধারণ করবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে কি না। তবে যারা অপরাধ করেছে, তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে কোনো অপরাধ করেনি।’
অন্যদিকে বিকেলে ভোলা সদর উপজেলা বিএনপির ইফতার মাহফিলে বিএনপি চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির বিশেষ সহকারী ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন বলেন, ‘আওয়ামী লীগের রাজনীতির কবর ৫ আগস্ট রচনা হয়েছে। আওয়ামী লীগ মৃত, তাকে আর নতুন করে নিষিদ্ধ করার কী আছে। বাংলার মাটিতে খুনি ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও আওয়ামী লীগের কোনো দিনই রাজনীতি করার অধিকার থাকবে না। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হলে তা রুখে দেওয়া হবে।’
ওইদিন সকালে রাজধানীর দক্ষিণখানে দুঃস্থদের মধ্যে ঈদসামগ্রী বিতরণ অনুষ্ঠানে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের যারা অপরাধী, তাদের বিচার নিশ্চিত হওয়ার পর যারা হত্যা-লুটপাটে জড়িত নয়, তাদের যদি জনগণ রাজনীতি করার সুযোগ দেয়, আমাদের কিছু বলার নেই। যারা ছাত্র হত্যা করেনি, অর্থ লোপাট করেনি— এমন সৎ ব্যক্তি নেতৃত্বে এলে আওয়ামী লীগ কেন রাজনীতি করতে পারবে না?’
অন্যদিকে বিকেলে ইস্কাটনের লেডিসক্লাবে আয়োজিত ইফতার মাহফিলে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গৌণ ইস্যুকে মুখ্য ইস্যু বানাতে গিয়ে নিজেদের অজান্তে ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যের মধ্যে সংশয়-সন্দেহের জন্ম দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে। আমি অন্তবর্তী সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আবারও বলতে চাই, সরকারের এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত হবে না যাতে রাষ্ট্র এবং রাজনীতিতে পলাতক স্বৈরাচারের দোসররা পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ পায়।’
একইদিন সন্ধ্যায় লক্ষ্মীপুর পৌর বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বলেন, ‘আজকে অনেকে বলেন- আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কথা। কিন্তু আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হলে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে করতে হবে। হঠাৎ করে আমি বলে দিলাম আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হয়ে গেল, জামায়াতকেও তো নিষিদ্ধ করছে, কিন্তু আসলে কি নিষিদ্ধ করতে পেরেছে? ওইরকম নিষিদ্ধের দরকার নেই। এমন একটা নিষিদ্ধের অবস্থানে আনতে হবে, যেখানে সব রাজনৈতিক দল একটা টেবিলে বসবে। সে টেবিলে বসার আগে সরকারের দায়িত্ব হলো আওয়ামী লীগ যে হত্যা করছে, গুম করছে, অত্যাচার করছে, নির্যাতন করছে, যেভাবে দুঃশাসন করছে, দুর্নীতি করছে— এগুলোর বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করা।’
তিনি বলেন, ‘বিচার প্রক্রিয়া যদি খুব দ্রুত করতে পারি, তাহলে হাসিনার বিচার হয়ে যাবে। হাসিনার পরিবারের বিচার হয়ে গেল মানে, তার দোসরদের বিচার হয়ে গেল। তাহলে এমনিতেই তো আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। নিষিদ্ধ যদি আলোচনার ভিত্তিতে হয়, পরবর্তী পার্লামেন্টে আমরা ইচ্ছে করলে সে (নিষিদ্ধের আইনি ভিত্তি) কাজগুলো সমাধান করতে পারব।’
অর্থাৎ গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে দেওয়া বিএনপি নেতাদের বক্তব্য ছিল সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী। তাদের বক্তব্যের মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না। একটা নির্দিষ্ট ইস্যুতে তারা যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তা দলীয় বক্তব্য নাকি ব্যক্তিগত বক্তব্য, সেটাও তারা পরিষ্কার করেননি।
অপরদিকে শনিবার (২২ মার্চ) দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিবকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি এখনই কোনো কমেন্ট করব না। দয়া করে ওদিকে ডাইভার্ট করবেন না।থ্যাংক ইউ।’
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই দলটিকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি শুরু থেকেই রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবে আঞ্চলিক সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত ‘জাতীয় ঐক্য ও বর্তমান বাস্তবতা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এখন বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ যাতে নিষিদ্ধ হয়, সেই আওয়াজ আমরা উঠাচ্ছি। আমরা আওয়ামী লীগের এই গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে বিচার দাবি করছি।’
তিনি বলেন, ‘বৈপ্লবিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখান করেছে, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। আপনারা (অন্তর্বর্তী সরকার) আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের জন্য মাঠে নামতে দেবেন না— আমরা এটা সমর্থন করি। কিন্তু এইভাবে কতদিন পুলিশ দিয়ে ঠেকাবেন? আপনারা বলবেন নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে চাই না, আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারবে না। কিন্তু, কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন? আইনি কোনো পদক্ষেপ কি এই নিয়েছেন?’
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম, সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বিচারের ব্যবস্থা করা হোক। সে অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করার দাবি জানিয়েছিলাম।’
সালাহউদ্দিন আহমেদের এই বক্তব্যের ৭ দিন পর ১৩ ফেব্রুয়ারি গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নিবন্ধন থাকা না থাকা বিষয়ে জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা এই বিষয়টা বারবার করে বলে আসছি যে, বিএনপি একটা লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি… আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, গণতন্ত্রের সব নর্মস অ্যান্ড কন্ডিশন যেগুলো আছে, সেগুলোর ওপর আমরা আস্থা রাখি এবং সেটা আমরা চর্চা করি… অতীতেও চর্চা করেছি।’
‘আমরা এই কথা বলে আসছি যে, ইট ইজ নট আস হু উইল ডিসাইড যে, কোন পার্টি নিষিদ্ধ হবে, কোন পার্টি কাজ করবে, কোন পার্টি কাজ করবে না… পিপলস উইল ডিসাইড। মানুষ বা জনগণ নির্ধারণ করবে কোনো পার্টি থাকবে কী থাকবে না, কোনো পার্টি নির্বাচন করবে কী করবে না।’
বিএনপি নেতাদের এই পরস্পরবিরোধী বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সারাবাংলাকে বলেন, ‘তোমরা এসব বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শোনো কেন? দলের অবস্থান আমরা অফিসিয়ালি জানাব।’
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম