৭১ এবং ২৪ কে এক কাতারে আনার প্রস্তাবে বিএনপির আপত্তি
২৩ মার্চ ২০২৫ ১৪:০৬ | আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৫ ১৭:০১
ঢাকা: ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকে এক কাতারে আনার যে প্রস্তাব দিয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশন, তাতে ঘোর আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি।
রোববার (২৩ মার্চ) দুপুরে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে নিজেদের প্রস্তবনা হস্তান্তরের পর আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘‘সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত কমিশনের স্প্রেডশিটে প্রথমেই যেটা থাকার দরকার ছিল, সেটা হল প্রস্তাবনা। সেই বিষয়টা উনারা স্প্রেডশিটে উল্লেখ করেন নাই, যেটা এক নম্বরে থাকা দরকার ছিল। সংবিধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রথম পৃষ্ঠার বিষয় হচ্ছে প্রস্তাবনা। সেটা পুরোপুরি পরিবর্তনের বা সংশোধনের একটা প্রস্তাব আসছে, অনেকটা রি-রাইটের মতো।’’
‘‘যেখানে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকে এক কাতারা নিয়ে আসা হয়েছে, যেটা সমীচীন বলে আমরা মনে করি না। এটাকে অন্য জায়গা রাখার বা তফসিল অংশে রাখার অথবা স্বীকৃতি দেওয়ার বিভিন্ন রকম সুযোগ আছে, সেটা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমরা পরে প্রকাশ করব। কিন্তু সেই প্রিয়ম্বলটা আমরা চাই, যেটা পঞ্চদশ সংশোধনীর পূর্বাবস্থা, যেটা ফিপথ অ্যামেনমেন্ডের পরে গৃহীত হয়েছিল বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায় অনুায়ী, সেই জায়গায় রাখা উচিত’- বলেন সালাহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘‘উনারা শুরুই করলেন রি-পাবলিক দিয়ে, রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তন দিয়ে। ‘প্রজাতন্ত্র’ না বলে ‘জনগণতন্ত্র’ বা ‘নাগরিকতন্ত্র’ বা পিপল রি-পাবলিক অব বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাংলায় ‘জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ লিখতে চান। সেটার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। দীর্ঘ দিনের প্রাক্টিসের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ এটা মেনে নিয়েছে বাংলাদেশের নাম। এখন এই বিষয়টা দিয়ে যে কতটুকু কী অর্জন হবে, সেটা প্রশ্নের দাবি রাখে।’’

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে নিজেদের প্রস্তবনা হস্তান্তর করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা নামে আলাদা একটা চ্যাপ্টার উনারা সংযোজন করেছেন। যেটা আসলে অনেকটা অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে হয় আরকি। যাদের পার্লমেন্টে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নাই, রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে হয়ত এ ধরনের অভিমত দিয়ে থাকতে পারে।’’
তিনি বলেন, ‘‘বিচারবিভাগ, নির্বাহী বিভাগ এবং আইনবিভাগে যে প্রস্তাবনাগুলো নিয়ে এসেছে, বিশেষ করে ন্যাশনাল কাউন্সিল গঠন করে কিছু অনির্বাচিত ব্যক্তিদের প্রধান করে যেসব এখতিয়ার, গঠন ও কার্যাবলীর প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে করে দেখা যাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আর কোনো গুরুত্ব থাকে না। সেখানে আমরা বলেছি, এটা পুনঃবিবেচনা করা যায়, আলাপ-আলোচনা করা যায়। রাষ্ট্র কাদের দ্বারা পরিচালিত হবে, এটা হচ্ছে আমাদের সংবিধানের মূল কথা। সেই জায়গা এটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আমরা মনে করি।’’
ছাত্রদের গণপরিষদের প্রস্তাব প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘‘গণপরিষদ হচ্ছে একটা রাষ্ট্র নতুন গঠন হয়েছে, সেখান সংবিধান প্রয়োজন, সংবিধান নাই। সেখানে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে প্রতিধিত্ব আকারে গণপরিষদ গঠন করা হয়। এটা নির্বাচনের মাধ্যমেও হতে পারে। আবার সিলেকশনের মাধ্যমেও হতে পারে। সেটা বিভিন্ন জায়গা ট্রেডিশন আছে।’
‘‘আমাদের রাষ্ট্র কি নতুন হয়েছে? আমরা এখন ৫৩/৫৪ বছরের পুরাতন রাষ্ট্র। আমাদের একটা সংবিধান আছে। সেই সংবিধানের হয়ত গণতান্ত্রিক চরিত্র বিনষ্ট হয়েছে। যার সঙ্গে আমরা একমত নই। সেই জন্য গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলো বিনির্মাণ করা দরকার নতুনভাবে। সেই জন্য আমরা সংবিধানের ব্যাপক সংশোধন প্রস্তাব এনেছি। যারা এই গণপরিষদের দাবি করেছে, তারাও ৬৯টা প্রস্তাব দিয়েছে সংশোধনের জন্য’’- বলেন সালাহউদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘‘দুদক সংস্কার কমিশনের স্প্রেডশিটে ২০ প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছিল হ্যাঁ/না মত দেওয়ার জন্য। এই ২০টার মধ্যে আমরা ১১টাতে সরাসরি একমত। আর সাতটা আমরা মন্তব্যসহ নীতিগতভাবে একমত। শুধুমাত্র একটিতে আমরা ভিন্ন মত পোষণ করেছি।’’
সালাহউদ্দিন বলেন, ‘‘প্রশাসন সংস্কার কমিশনের যেসব প্রস্তাব আমরা পেয়েছি, সেখানে আমরা প্রায় অর্ধেক বিষয়ে একমত। ২৬ টার মতো প্রস্তাবনা সেখানে আছে। আর বাকি অর্ধেক বিষয়ে আমাদের মতামত আছে, মন্তব্য আছে। তার মধ্যে একটা আছে বিদ্যমান এস এস বি (সুপ্রিয়র সিলেকশন বোর্ড) ব্যবস্থা বাতিলের একটা সুপারিশ। এর পরিবর্তে মন্ত্রিপরিষদ কমিটি গঠন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আমরা মনে করি, এখানে প্রশাসনে রাজনীতিকরণের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তাই এখানে দ্বিমত পোষণ করেছি।’’
তিনি বলেন, ‘‘বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রায় সব প্রস্তাবের সঙ্গে আমরা একমত। আমরা আমাদের ৩১ দফা প্রস্তাবনার মধ্যে বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার কথা বলেছি। সংস্কার কমিশনে জুডিশিয়ারি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার জন্য যেসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে আমরা একমত এবং আমাদের নিজস্ব মতামতও আছে। সেখানে মন্তব্যসহ মতামত দিয়েছি।’’
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের ২৭টার মতো প্রস্তাব দিয়েছেন, যার মধ্যে অধিকাংশ প্রস্তাব সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আমরা ঠিক বুঝতে পারিনি নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত অথবা নির্বাচন ব্যবস্থা সংক্রান্ত রিপোর্টে কিছু কিছু বিষয়ে বা ক্ষেত্রে সংবিধানের সংশ্লিষ্টতা আছে। কিন্তু অধিকাংশ বিষয় যেগুলো দেখা যায় নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের কাজ নয়, কিন্তু সেগুলো এসছে। এটা উনারা ভালো এক্সপ্লেইন করতে পারবেন। এই বিষয়ে আমরা আমাদের প্রস্তাব সংবিধান সংশোধন কমিশনের প্রস্তাবে উল্লেখ করেছি।’’
তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতাকে খর্ব করার জন্য এই সংস্কার কমিশন কিছু রিপোর্ট দিয়েছে। যেগুলো আমরা মনে করি নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। যেগুলো আমরা মনে করি নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারের মধ্যেই থাকা উচিত। যেমন এনআইডি কার্ড। এনআইডি যদি আলাদা কোনো স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের কাছে দেওয়া হয়, তাহলে নির্বাচন কমিশনকে বারবার এনআইডি সংক্রান্ত বিষয়ের জন্য অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে যেতে হবে। তার চাইতে বর্তমানে যে বহাল আছে, যদিও একটা আইন আছে, সেই আইনের বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে ন্যাস্ত করা হয়েছির। আমরা মনে করি, এই আইন বাতিল করে এনআইডি নির্বাচন কমিশনের হাতে নিয়ে যাওয়া উচিত।’’
সালাহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ ও অধ্যাপক ড. বোরহানউদ্দিন।
সারাবাংলা/এজেড/ইআ