চট্টগ্রাম বিএনপিতে অন্তর্কোন্দল-সংঘাত, সাড়ে ৭ মাসে ৬ প্রাণহানি
২৩ মার্চ ২০২৫ ২২:৫৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে অন্তর্কোন্দলে একের পর এক সংঘাতে জড়াচ্ছেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। গতবছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে গত সাড়ে সাত মাসে অর্ধশতাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে অন্তত ছয়জনের। এর মধ্যে রাউজানে তিনজন, ফটিকছড়িতে একজন এবং চট্টগ্রাম নগরীতে দু’জন। সর্বশেষ নগরীতে একটি সংঘাতের ঘটনার পর থানার ওসিকে পর্যন্ত স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে।
মূলত আধিপত্য বিস্তার নিয়ে চট্টগ্রাম নগরী ও বিভিন্ন উপজেলায় এসব সংঘাতের ঘটনা ঘটছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে রাউজান উপজেলার পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সেখানে ছয় মাসে পাঁচজন খুন হয়েছেন, যার মধ্যে তিনজন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়ানোর কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে বিএনপি।
অন্তর্কোন্দলে সংঘাতের ঘটনা নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, চট্টগ্রামসহ সারাদেশে বিভিন্ন অভিযোগে দুই হাজারের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি। তদন্ত ছাড়াই তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিএনপির নেতাকর্মী হলেও এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেফতারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায় ‘গডফাদারের’ তকমা পাওয়া সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর আমলে আওয়ামী লীগের ১৫ বছর বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ঘরছাড়া ছিলেন। অনেক নেতাকর্মী বিদেশে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। যারা দেশে ছিলেন, তারাও রাউজানে যেতে পারতেন না।
গতবছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর রাউজানের বিএনপি নেতাকর্মীরা ফিরে আসেন। কিন্তু শুরু থেকেই রাউজানে বিএনপি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এর জেরে চলছে সংঘাত-খুনোখুনির ঘটনা। এ বছরের ১৫ মার্চ পর্যন্ত গত ছয় মাসে রাউজানে পাঁচজন খুন হয়েছেন, এর মধ্যে তিনজন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
রাউজান উপজেলার কদলপুর, উরকিরচর, পূর্ব গুজরা, পাহাড়তলী, রাউজান সদর, পশ্চিম গুজরা, হলদিয়া, ডাবুয়া ইউনিয়নে সংঘর্ষ-মারামারির ঘটনা ঘটেছে। এ সব ঘটনায় বিএনপি নেতা থেকে শুরু করে যুবদল, ছাত্রদল ও অন্য অঙ্গ সংগঠনের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এবং তিন শতাধিক আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে সমস্যা যেটা হয়েছে, কিছু নেতার অদূরদর্শিতার কারণে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী আমাদের দলে অনুপ্রবেশ করেছে। তারাই মূলত অন্তর্কোন্দল তৈরি করে নানা ঘটনা ঘটাচ্ছে। রাউজানে যেটা হয়েছে, আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ফজলের করিমের কিছু লোক বিভিন্ন ব্যানারে বিএনপিতে ঢুকে গেছে। তারা দলের ভেতরে ঢুকে ঐক্য নষ্ট করেছে।’
এ ছাড়া, গত ১৮ মার্চ রাতে ফটিকছড়ি উপজেলার ভুজপুর থানার দাঁতমারা ইউনিয়নের শান্তিরহাট বাজারে বিএনপির দু’গ্রুপে সংঘর্ষে মো. রমজান আলী নামে এক যুবক নিহত হন। গত আট মাসে চট্টগ্রামের রাউজানের পাশাপাশি মীরসরাইয়ে সবচেয়ে বেশি সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি মীরসরাই উপজেলা, মীরসরাই পৌরসভা এবং বারইহারহাট পৌরসভা বিএনপির কমিটি বিলুপ্তির ঘোষণা করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম নগরীতেও সংঘাতে এ পর্যন্ত দু’জন নিহত হয়েছেন। গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর নগরীর পুরাতন চান্দগাঁও এলাকায় একটি খেলার মাঠ দখল নিয়ে যুবদলের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ হয়। এ সময় ছুরিকাঘাতে জুবায়ের উদ্দীন বাবু (২৫) নামে যুবদলের এক কর্মী নিহত হন। ওইদিন রাতেই মহানগর যুবদলের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। পাশাপাশি সংঘর্ষে জড়িত দুই নেতাকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় কমিটি।
এর পর গত বছরের ১১ অক্টোবর রাতে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি এলাকায় আধিপত্য নিয়ে সংঘাতে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত মোহাম্মদ ইমন (২৮) নামের আরেক যুবক খুন হন। এ ঘটনার পর মহানগর ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম, তার ভাই থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. সবুজ এবং কৃষক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক শাহ আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
জানা গেছে, নগরীর খুলশী, বায়েজিদ বোস্তামি, লালখান বাজার, চান্দগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় গত আট মাসে ২০টিরও বেশি সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ঈদুল ফিতরের ব্যানার টানানোকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী থানার কুসুমবাগ এলাকায় বিএনপির দু’গ্রুপে গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগে খুলশী থানার ওসি মুজিবুর রহমানকে স্ট্যান্ড রিলিজের আদেশ দেন সিএমপি কমিশনার।
বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘নেতাকর্মীদের বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে আমরা জিরো টলারেন্সে আছি। বিএনপি একমাত্র দল, যে দল নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত যত ঘটনা ঘটেছে, তার প্রতিটির জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম