Tuesday 01 Apr 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যে কারণে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৯ মার্চ ২০২৫ ২২:৩৫

ভূমিকম্প। প্রতীকী ছবি

ঢাকা: ২৮ মার্চ হঠাৎ-ই ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে মিয়ানমার। ভূমিকম্পে দেশটিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে কয়েক হাজার মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। যে কারণে ছয়টি অঞ্চলে জরুরি অবস্থা জারি করেছে মিয়ানমার সরকার। ভূমিকম্প এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, শত শত মাইল দূরে থাইল্যান্ডেও তা জোরালোভাবে অনুভূত হয়। এবং দেশটির রাজধানী ব্যাংককে ভবন ধসে পড়ে। এমনকি ভূ-কম্পন অনুভূত হয় বাংলাদেশেও। যার উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৫৯৭ কিলোমিটার দূরে।

বিজ্ঞাপন

এর আগে গত ৭ জানুয়ারি ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পে তিব্বতে হাজারো ঘরবাড়ি মাটির সঙ্গে মিশে যায়। মারা যায় শতাধিক মানুষ। এই ভূমিকম্পগুলো বাংলাদেশের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ বলছে, মাটির নিচের প্লেটগত কারণে বাংলাদেশ বর্তমানে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। সেজন্য ভূমিকম্প সহনীয় নিরাপদ অবকাঠামো তৈরি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণা করছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগ।

বিজ্ঞাপন

ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ বলছে, ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মা (মিয়ানমার) এই তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। এর মধ্যে ইন্ডিয়ান ও বার্মার প্লেটের সংযোগ স্থলে অবস্থিত সিলেট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লেটগুলো সক্রিয় এবং পরস্পরের দিকে ধাবমান। যে কারণে এই অঞ্চলে ভূমিকম্পের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। সদ্য মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে হওয়া ভূমিকম্প বাংলাদেশের সেই ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৫০ বছরের সাইকেল হিসেবে বাংলাদেশে এখন ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার শঙ্কা খুবই জোরালো হয়েছে। গত পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে সম্প্রতি ভূমিকম্পের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। তাই বড়ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আগেই প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ তাদের।

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ আর্থকোয়াক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতি ১০০-১৫০ বছর পর পর ৭ মাত্রার ভূমিকম্প আসে। আর প্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ বছর পর পর আসে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প। ১৫০ বছরের সাইকেল হিসেবে বাংলাদেশে এখন ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার শঙ্কা খুবই জোরালো। গত পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে সম্প্রতি ভূমিকম্পের সংখ্যা অনেক বেড়েছে যা, বাংলাদেশকে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।’

আবহাওয়া অধিদফতরের ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে গত এক মাসে বাংলাদেশে পাঁচবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। যার সবগুলোর কেন্দ্রস্থল ছিল ঢাকা থেকে ১৯৬ থেকে ২৩২ কিলোমিটার উত্তরপূর্বে। বিশ্লেষকদের মতে, বড় ধরনের ভূমিকম্পের আগে বা পরে এমন ছোট ছোট ভূকম্পন অনুভূত হয়। যে কারণে ভবিষ্যতের বড় বিপদ বিবেচনায় এখনি প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ তাদের।

এ বিষয়ে ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী আরও বলেন, ‘এখানে দু’টি থিওরি আছে। ছোট ছোট ভূমিকম্প হলে বড় ভূমিকম্প নাও হতে পারে, আবার বড় ঝাঁকুনির প্রস্তুতি হিসেবে ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়ে থাকে। প্রশ্ন হলো- আমরা কোনটা বিবেচনায় নিয়ে এগোব? আমাদের তো অবশ্যই সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে। বড় ভূমিকম্পের প্রস্তুতি যদি নিই তাহলে আমরা ঝুঁকিমুক্ত। কিন্তু আমরা যদি মনে করি ছোট ছোট ভূমিকম্প হচ্ছে, তাই বড় ভূমিকম্প হবে না, আর সত্যিই যদি বড় ভূমিকম্প হয়েই যায়, তাহলে যে বিপর্যয় নেমে আসবে তা কল্পনা করাও অসম্ভব।’

তিনি আরও বলেন, ‘২০১৫ সালে যখন নেপালে ভূমিকম্প হয় তখন আমি সরকারি যে কমিটিগুলোতে কাজ করেছিলাম, বারবার বলেছিলাম রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর আমরা যেমন ভবনগুলো চেক করেছি, চেক করে সার্টিফিকেশন ব্যবস্থা করেছি, ঠিক একইভাবে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোর বিল্ডিংগুলো চেক করে সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। এত বছর হয়ে গেল কেউ কানেই তুললেন না।’

যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘আর্থ অবজারভেটরি’। আর্থ অবজারভেটরি সূত্রে জানা যায়, দেশে বিপজ্জনক ভূকম্পনের প্রধান দু’টি উৎস রয়েছে। এর একটি ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাউকি ফল্ট, আরেকটি টেকনাফ পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল সাবডাকশন জোন। বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে এসব তথ্য নিয়ে বড়ধরনের ভূমিকম্পের ক্ষতি কীভাবে কমিয়ে আনা যাবে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে কাজ করছে সরকার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন এই উদ্যোগ চলমান। দেশের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত প্যানেল এ বিষয়ে কাজ করছে বলে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ তার ভেরিফাইড ফেইসবুকে লিখেছেন, ‘আমার একাডেমিক পড়ালেখার আলোকে আপনাদের নিশ্চিত করে বলতে চাই, ভূমিকম্প সংগঠিত হওয়ার নির্দিষ্ট সময় ও স্থান বিষয়ে নির্দিষ্ট করে পূর্বাভাস করা যায় না; যেমন পূর্বাভাস করা যায় আবহাওয়া সম্পর্কিত বিষয় যেমন ঘুর্ণিঝড় নিয়ে। বাংলাদেশে কোন দিনে বা কোন বছরে একটি বড় ভূমিকম্প সংগঠিত হবে তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব না।’

তিনি আরও লিখেন, ‘যেহেতু বড়-বড় ভূমিকম্পগুলো সংগঠিত হয়ে পৃথিবীর নির্দিষ্ট কিছু স্থানে, তাই ভূ-বিজ্ঞানীরা জানেন- কোন স্থানে বড় ভূমিকম্প হওয়ার ঝুঁকি কেমন পরিমাণে থাকে। ভূমিকম্প বিষয়ে গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে ভূ-বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত যে, বাংলাদেশ সবসময়ই বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশের দুই দিকে (পূর্ব দিকে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারত সীমান্তে এবং উত্তর দিকে বাংলাদেশ ও ভারতের মেঘালয় সীমান্তে) যেকোনো সময় ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে।’

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সর্বশেষ বড় মাত্রার ভূমিকম্প ঘটেছিল ১৭৬২ সালে, যার মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৫ রিখটার স্কেলে। এরপর ১৮৯৭ সালে আসামে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার, ১৯১৮ সালে সিলেটের বালিসিরা উপত্যকায় ৭ দশমিক ৬ মাত্রার এবং ১৯৩০ সালে আসামের ধুবড়িতে ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়।

সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম

উচ্চমাত্রা ঝুঁকি বাংলাদেশ ভূমিকম্প

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর