প্রাইভেট কারে গুলি ছুঁড়ে খুন: অভিযোগ ছোট সাজ্জাদের বাহিনীর বিরুদ্ধে
৩০ মার্চ ২০২৫ ১৬:০৯ | আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২৫ ১৮:৪৫
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীতে প্রকাশ্যে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে প্রাইভেট কারকে ধাওয়া দিয়ে দুজনকে খুনের ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ‘ছোট’ সাজ্জাদের বাহিনী জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। নিহত একজনের পরিবার এবং আহত একজন এ অভিযোগ করেছেন।
নিহতদের একজন মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। তার মা ও স্ত্রী জানিয়েছেন, বর্তমানে কারাবন্দী ছোট সাজ্জাদ দুই মাসে আগে আবদুল্লাহকে পায়ে গুলি করে আহত করেছিল। সাজ্জাদের প্রতিপক্ষ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত সরোয়ার হোসেন বাবলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকায় আবদুল্লাহ তার রোষানলে ছিল। প্রাইভেট কারে থাকা সরোয়ার ও আবদুল্লাহকে টার্গেট করা হয়েছিল বলে তাদের দাবি।
কর্ণফুলী নদীর বালুমহাল নিয়ে বিরোধ, ছোট সাজ্জাদকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য সরোয়ারকে সন্দেহের জেরে এ ঘটনা ঘটতে পারে বলে আভাস মিলেছে। তবে পুলিশ তদন্তের আগে এ বিষয়ে কিছুই বলছে না।
শনিবার (২৯ মার্চ) গভীর রাতে নগরীর বাকলিয়া থানার শাহ আমানত সেতু এলাকা থেকে চলন্ত প্রাইভেট কারটিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে একাধিক মোটর সাইকেলে থাকা সন্ত্রাসীরা। ধাওয়ার মুখে কারটি বাকলিয়া এক্সেস রোড দিয়ে এসে চন্দনপুরায় প্রবেশমুখে থেমে যায়। তখন মোটর সাইকেলে আসা সন্ত্রাসীদের মুহুর্মুহু গুলিতে দুই জন নিহত হন। আহত হন আরও দুই জন।
নিহতরা হলেন- প্রাইভেট কারের মালিক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ও চালক বখতেয়ার উদ্দিন মানিক। তাদের বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। আবদুল্লাহ’র বাড়ি কক্সবাজার জেলায়। মানিকের বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায়। তবে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার শেরশাহ এলাকায় থাকতেন।
আহতরা হলেন- মো. রবিন ও মো. হৃদয়। তারা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তাদের বাসাও নগরীর শেরশাহ এলাকায়।
রবিন সারাবাংলাকে জানান, তিনি পেশায় সিএনজি অটোরিকশা চালক। আবদুল্লাহ ও মানিক তার বন্ধু। ঘটনার সময় কারে মোট ছয়জন ছিলেন। কারচালক মানিকের পাশের সিটে বসেছিলেন সরোয়ার হোসেন বাবলা। আর পেছনের সিটে ছিলেন রবিন, আবদুল্লাহ, ইমন ও হৃদয়।
শনিবার রাত ৯টার দিকে শেরশাহ থেকে আবদুল্লাহ, মানিক, রবিন ও ইমন মিলে ঈদের কেনাকাটা করার জন্য প্রাইভেট কারে বের হন। ঘন্টাখানেক পর সরোয়ার আবদুল্লাহকে ফোন করে বাকলিয়ায় শাহ আমানত সেতু এলাকায় যেতে বলেন। তারা কার নিয়ে সেখানে যান। সেতুর পশ্চিমে নিচে বালুমহালে একটি একতলা পরিত্যক্ত ভবনের ছাদে আগে থেকে সরোয়ার ও হৃদয় বসা ছিলেন। তারাও সেখানে পৌঁছে কিছুক্ষণ অবস্থান করেন।
রবিন বলেন, ‘দুই ঘন্টারও বেশিসময় ধরে সরোয়ার ভাই মিটিং করছিলেন। আমরা কাছে ছিলাম। পরে ক্ষুধা লাগায় আমি আর ইমন সেকুর ওপাড়ে মইজ্জ্যারটেকে হোটেলে ভাত খেতে যায়। ভাত খেয়ে আসার আরও ঘন্টাখানেক পর রাত আড়াইটার দিকে সরোয়ার ভাইসহ আমরা কার নিয়ে বেরিয়ে আসি।’
তার ভাষ্য অনুযায়ী, শাহ আমানত সেতু এলাকায় বালুমহাল থেকে বের হয়ে প্রাইভেট কার বহদ্দারহাটের দিকে যাচ্ছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পেছন থেকে আগে থেকে তাদের অনুসরণ করা ৩-৪টি মোটর সাইকেল থেকে সন্ত্রাসীরা গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। তাদের মাথায় হেলমেট ছিল। পেছনে বসা আবদুল্লাহ কারের ভেতরেই গুলিবিদ্ধ হন।
গুলির মুখে প্রাইভেট কারটি বাকলিয়া এক্সেস রোডে ঢোকে। চন্দনপুরায় ওই সড়কের প্রবেশমুখে পৌঁছানোর পর পুলিশের একটি গাড়ি দেখতে পেয়ে ছয়জন সেখান থেকে নেমে যান এবং পুলিশের কাছে বাঁচানোর আকুতি জানান। ছয়জন এলোপাতাড়ি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পরিস্থিতি বোঝার আগেই পেছনে মোটর সাইকেলে আসা সন্ত্রাসীদের মুহুর্মুহু গুলিতে আবদুল্লাহ ও মানিক ঘটনাস্থলে মারা যান। রবিন ও হৃদয় পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন।
এ সময় সরোয়ার ও ইমন দৌড়ে পালিয়ে কোনোমতে প্রাণ রক্ষা করেন। রবিন আহত অবস্থায় দৌড়াতে গিয়ে একটি রেস্টুরেন্টের সামনে পড়ে যান। রেস্টুরেন্টের লোকজন তাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন বলে রবিনের ভাষ্য।
কী কারণে তাদের ওপর হামলা, জানতে চাইলে রবিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরোয়ার ভাই বিএনপি করেন। আবদুল্লাহ উনার বেশি ঘনিষ্ঠ। ছোট সাজ্জাদের সঙ্গে সরোয়ার ভাইয়ের আগে থেকে বিরোধ আছে। শুনেছি, পুলিশের হাতে ধরা পড়ার জন্য সাজ্জাদ সরোয়ার ভাইকে সন্দেহ করে। যারা হামলা করেছে তারা সাজ্জাদের লোক। তারা সরোয়ার ভাইকে মারতে এসেছিল।’
চমেক হাসপাতালের লাশঘরের সামনে বসে আহাজারি করছিলেন নিহত আবদুল্লাহর মা রাশেদা বেগম, স্ত্রী পিয়ামণিসহ স্বজনরা। সরোয়ারের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় আবদুল্লাহ ছোট সাজ্জাদের রোষানলে পড়েছিল বলে তারা জানান।
রাশেদা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাস দুয়েক আগে সাজ্জাদ্যা রাউজানে আমার ছেলের পায়ে গুলি করেছিল। আমার ছেলে দুই মাস ঘর থেকে বের হতে পারেনি। ঈদের শপিং করার জন্য দুই মাস পর বের হয়েছে। সাজ্জাদ্যার সন্ত্রাসীরা আমার ছেলেকে খুন করেছে। আমি বিচার চাই।’
পিয়ামণি সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাজ্জাদ গ্রুপের লোকজন আমার স্বামীকে খুন করেছে। আবদুল্লাহ কেন সরোয়ারের সাথে থাকে, তার সাথে কথা বলে, এজন্য সাজ্জাদের খুব রাগ। আবদুল্লাহকে পায়ে গুলিও করেছিল। আমাদের ধারণা, সরোয়ারকে মারতে হামলা করেছিল সাজ্জাদের লোকজন। আবদুল্লাহও তামের টার্গেট ছিল।’
তিনি জানান, শনিবার সকাল ৯টার দিকে আবদুল্লাহ বাসা থেকে বের হন। সন্ধ্যায় বাসায় ইফতার করার কথা থাকলেও যাননি। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার স্ত্রীকে ফোন করে নিউমার্কেট গিয়ে কেনাকাটার জন্য টাকা দিয়ে আসতে বলেন। রাত সাড়ে ৯টার দিকে পিয়ামণি এক লাখ ৩০ হাজার টাকা নিয়ে নিউমার্কেট গিয়ে স্বামীর হাতে দেন।
‘তখন আমাদের কারে আবদুল্লাহ ও মানিক বসা ছিল। পেছনের সিটে কারা ছিল দেখিনি। আবদুল্লাহ বলল, সরোয়ার ভাই ফোন করেছেন, আমি নতুন ব্রিজ যাচ্ছি। রাত ২টার দিকে আমি তাকে ভিডিও কল দিই। দেখি, সেখানে একটি বালুর টালের মাঝে সরোয়ার ভাই বসে কথা বলছেন। এরপর থেকে তার মোবাইল বন্ধ পাই। সকালে রবিন আমাকে তার মারা যাবার খবর জানায়,’ – বলেন পিয়ামণি।
চকবাজার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. জাহেদুল কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তদন্ত শুরু করেছি। তদন্তের আগে এ বিষয়ে কিছু বলা যাবে না।’
উল্লেখ্য, গত ১৫ মার্চ ঢাকার বসুন্ধরা থেকে গ্রেফতার হওয়া সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ছোট সাজ্জাদ ও সরোয়ার হোসেন বাবলার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে আধিপত্যের বিরোধ চলছে। সেই বিরোধে এর আগেও হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
সারাবাংলা/আরডি/ইআ