চট্টগ্রামের ‘ক্ষমতাধর’ সাবেক ৩ এমপির ঈদ এবার জেলখানায়
৩০ মার্চ ২০২৫ ২০:০৬ | আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২৫ ২২:৩৪
সাবেক এমপি এম এ লতিফ, আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দীন নদভী ও এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামের একসময়ের ক্ষমতাধর আওয়ামী লীগ দলীয় তিন সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী, এম এ লতিফ ও আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দীন নদভী। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাদের ঠাঁই হয়েছে কারাগারে। পাচ্ছেন না ডিভিশন সুবিধা। থাকছেন সেলে সাধারণ হাজতির মতোই। আর সাধারণ হাজতি হয়েই সেই ক্ষমতাধরদের ঈদ করতে হচ্ছে এবার জেলখানায়।
তবে কারাবিধি অনুযায়ী ঈদে একজন সাধারণ বন্দী যেসব সুযোগ-সুবিধা পান, সাবেক সংসদ সদস্যরাও একই সুবিধা পাবেন। কারা কর্মকর্তারা বলছেন, সাবেক সংসদ সদস্য, আমলা কিংবা ব্যবসায়ী- যতই ভিআইপি হোক, কারাবিধির বাইরে কেউ অতিরিক্ত কোনো সুবিধা পাবেন না।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মোহাম্মদ মাসুদ হাসান জুয়েল সারাবাংলাকে জানান, ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে প্রত্যেক বন্দীর জন্য এবারও কারাগারে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঈদের দিন বন্দিদের সকালে পায়েস-মুড়ি, দুপুরে পোলাও, গরুর গোশত, মিষ্টি ও সালাদ এবং রাতে সাদা ভাত, মাছ ও আলুর দম পরিবেশন করা হবে। ঈদের দ্বিতীয় দিন বন্দীরা কারাগারে পরিবেশিত খাবারের বাইরেও তাদের বাসা কিংবা আত্মীয়স্বজনের পাঠানো খাবার খেতে পারবেন।
এছাড়া ঈদের তিনদিন বন্দী তাদের স্বজনদের সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাতের সুযোগ পাবেন। প্রত্যেক বন্দী একবার ১০ মিনিট করে সাক্ষাতপ্রার্থীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাবেন। আর পাঁচ মিনিট করে মোবাইলে কথা বলার সুযোগ পাবেন।
জেলার মোহাম্মদ মাসুদ হাসান জুয়েল বলেন, ‘সাধারণত একজন বন্দী ১৫ দিন পর পর একবার সাক্ষাতের সুযোগ পান। তবে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে কারাবিধি অনুযায়ী সেই নিয়ম থাকছে না। ঈদের সময় ১০ মিনিট করে নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে সাক্ষাত এবং ৫ মিনিট মোবাইলে কথা বলার সুযোগ পাবেন বন্দীরা। সকল বন্দীর জন্য সমান সুযোগ আমরা নিশ্চিত করবো। রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক পরিচয়ের কারণে কেউ বাড়তি কোনো সুযোগ পাবে না।’
এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতে পালানোর পথে ১২ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্তের আবদুল্লাহপুর এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
আওয়ামী লীগের আমলের পুরো সময় তিনি বিরোধী মতের মানুষসহ পুরো রাউজানবাসীর কাছে ছিলেন ‘মূর্তিমান আতঙ্ক’। ব্যাপক ক্ষমতাধর ফজলে করিমের গুম-খুন, বিরোধী মতের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি নিজ দলের বিরুদ্ধ মতের নেতাকর্মীদের নির্যাতন করে এলাকা ছাড়তে বাধ্য করা, নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলে এলাকায় রাজত্ব কায়েম করা, সরকারি জায়গা দখলসহ বিস্তর অভিযোগ আছে। কারাবন্দী ফজলে করিমের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত এক ডজনেরও বেশি মামলা হয়েছে।
এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী ১৯৯৬ সালের আগে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে সেবছর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসন থেকে মনোনয়ন পান। কিন্তু জিততে পারেননি। এরপর ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য হন তিনি। এরপর ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালেও আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য হয়েছেন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
এম এ লতিফ চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। সরকার পতনের পর গত বছরের ১৭ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরী থেকে লতিফকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সেই থেকে কারাগারে আছেন লতিফ। ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা থেকে ২০০৮ সালে হঠাৎ আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছিলেন। ২০০৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ক্ষমতার অপব্যবহার, ব্যবসায়ীদের হয়রানি, ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম চেম্বারকে কুক্ষীগত করে পারিবারিক সংগঠনে পরিণত করাসহ বিভিন্ন অভিযোগে বিতর্কিত ছিলেন লতিফ।
আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দীন নদভী চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। সরকারের পতনের পর গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর রাতে নদভীকে রাজধানীর উত্তরা এলাকা থেকে গ্রেফতার করে ডিএমপির গোয়েন্দা ইউনিট (ডিবি)। দীর্ঘসময় জামায়াত ঘরানার সঙ্গে থেকে নদভী ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত দুই সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে চট্টগ্রাম-১৫ আসন থেকে দুই দফায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০২৪ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান, তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে যান।
জেলার মোহাম্মদ মাসুদ হাসান জুয়েল সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফ এবং আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দীন নদভী বর্তমানে চট্টগ্রাম কারাগারে আছেন। তাদের ঈদুল ফিতর হবে এ জেলখানায়। আর এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী গ্রেফতারের পর থেকে চট্টগ্রাম কারাগারে থাকলেও গত মাসে তাকে অন্য কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিভাগের আওতাধীন আরও তিনটি আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্যরাও চট্টগ্রাম কারাগারে ছিলেন। এরা হলেন- কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের আব্দুর রহমান বদি, নোয়াখালী-৪ (সদর ও সুবর্ণচর) আসনের একরামুল করিম চৌধুরী এবং নোয়াখালী-৬ (হাতিয়া) আসনের মোহাম্মদ আলী।
সূত্রমতে, এম এ লতিফ ও আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দীন নদভী ছাড়া বাকি সাবেক সংসদ সদস্যরা কাশিমপুর কারাগারে আছেন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) সাবেক কমিশনার সাইফুল ইসলাম, বরখাস্ত হওয়া এএসপি রফিকুল ইসলাম, শিল্পপতি মো. মহসিন ও জহির আহমেদ রতনসহ আলোচিত ডজনখানেক ‘ভিআইপি’ বন্দী চট্টগ্রাম কারাগারে আছেন, যারা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর একে একে গ্রেফতার হন।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম
আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী টপ নিউজ সাবেক এমপি এম এ লতিফ