জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে কমছে ফুল উৎপাদন
৭ এপ্রিল ২০২৫ ১০:০০ | আপডেট: ৭ এপ্রিল ২০২৫ ১০:৩২
ঢাকা: প্রকৃতিজুড়ে গ্রীষ্মের আবহ উপলব্ধি হলেও এখনো চলছে বসন্ত। বসন্ত মানেই প্রকৃতির প্রাণপল্লবে প্রসূণের হাতছানি। সবুজ কচিপাতার পাশাপাশি বাগানে হরেক রকমের বাহারি ফুল দোলে এই বসন্তে। দেশি তো বটেই, দেখা মেলে বিদেশি ফুলের সমারোহ। কিন্তু জলাবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে প্রকৃতি বিরূপ আচরণ শুরু করেছে। এতে প্রকৃতির অন্যান্য সমস্যার পাশাপাশি ফুলের উৎপাদনও কমে গেছে।
সম্প্রতি সাভারের গেন্ডা এলাকার গোলাপ গ্রামে সরেজমিনে দেখা যায়, ফাগুনের প্রাণখোলা হাসি যেন বাগান জুড়ে। গোলাপের কুঁড়িতে কুঁড়িতে লেগেছে খুশির দোল। গাঁদা, গোলাপ, জারবারা, স্টার, রজনীগন্ধা, চন্দ্রমল্লিকা, গ্লাডিওলাসসহ নানা জাতের ফুল ফুটে আছে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে, তারপরেও হাসি নেই ফুলচাষীর মুখে। বরং, চোখে-মুখে হতাশার ছাপ।
২১ বছর ধরে ফুল চাষ করেন মুসা মিয়া। সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘যা ফুল দেখতাছেন, এগুলা তো কিছুই না। আমি ১০ বছর আগে পাঁচ বিঘা জমিতে যে ফুল উৎপাদন করতাম, এখন সেই তুলনা কিছুই হয় না। গত পাঁচ বছর ধরেই ফুলের উৎপাদন কমা শুরু করছে। সেই দুঃখ আপনারা বুঝবেন না।’

গোলাপের কুঁড়িতে কুঁড়িতে লেগেছে খুশির দোল। ছবি: সারাবাংলা
একই কথা বললেন গোলাপ চাষি আলী মোহাম্মদ। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘অজানা কোনো এক রোগে দ্রুতই গোলাপ ঝরে যাচ্ছে। আবার ফুটছেও দেরিতে। তাই বিশেষ উৎসবের আগেই ফুল তুলে ফেলতে হচ্ছে। বসন্তকালেই আমাদের ব্যবসা ভালো হয়। এর পর বৈশাখে কিছুটা লাভ করি। কিন্তু, বৈশাখের আগেই অনেককে ফুল তুলে ফেলতে হচ্ছে। এ ছাড়া, অনেক ডালে ঠিকমতো ফুলই হচ্ছে না। বৃষ্টির সময় বৃষ্টি হয় না, যখন রোদ দরকার তখন রোদ হয় না। মাটি ঠিক মতো উর্বর হয় না। এসব কারণে ফুলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে।’
এ বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি ও শাহবাগ ফুল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শ্রী বাবুল প্রসাদের সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফুল উৎপাদন কমতে শুরু করেছে। আমরা প্রথম ও সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খাই ২০০৭ সালের সিডর-এ। সে সময় ফুলের বাগান, খেত সব পানিতে ভেসে যায়। সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে আমাদের বেশ সময় লেগেছিল। কোনোরকমে সেই বিপদ কাটিয়ে উঠেছিলাম। এর পর ফলনও ভালো হচ্ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আমাদের দ্বিতীয় ধাক্কাটা দেয়। যে কারণে ফের ফুল উৎপাদন কমে যায়। এর পর মাটি তার উর্বরতা হারিয়ে ফেলে।’

গত পাঁচ বছর ধরেই ফুলের উৎপাদন কমা শুরু করছে। ছবি: সারাবাংলা
তিনি বলেন, ‘বর্ষাকালে বৃষ্টি হচ্ছে না, শীতের সময় গরম। বসন্তকালে হঠাৎ-ই কালবৈশাখী আসছে। এমন ঋতু পরিবর্তনের কারণে ঠিক মতো পুষ্টি ও উর্বরতা পাচ্ছে না ফুল গাছগুলো। মাটি থেকে যে প্রাণশক্তি তাদের পাওয়ার কথা, সেটাও নিয়মিত পাচ্ছে না। বা বলা যায়, একটা গাছের জন্য যে চাহিদা, সেগুলো ঠিকমতো সঞ্চালন করতে না পারায় ফুল ঠিকমতো ফুটছে না। আবার বসন্তে যে ফুল ফোটার কথা, তা আগেই ফুটে ঝরে যাচ্ছে। আবার যে গাছে সারাবছরই ফুল ফোটে সেই গাছেও ছয় মাস ফুল নাই। ডালগুলোও ফুল না দিয়েই মরে যাচ্ছে। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনই আমাদের ফুল উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে।’
বাবুল প্রসাদ আরও বলেন, ‘ফুল চাষী ও ব্যবসায়ীরা আরও একটি বড় ধাক্কা খায় করোনার সময়। এই সময় ঠিক মতো ফুল সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। আবার গাছের ফুল গাছেই মরে গেছে। চাষীরাও শাটডাউনের কারণে ঠিকমতো চাষাবাদ করতে পারেনি। সবমিলিয়ে ফুল উৎপাদন গত ১০ বছরের তুলনায় কম।’

গত পাঁচ বছর ধরেই ফুলের উৎপাদন কমা শুরু করছে। ছবি: সারাবাংলা
এই অবস্থান থেকে উত্তরণে করণীয় কী? জানতে চাইলে বাবুল প্রসাদ বলেন, ‘সেরকম না হলেও ফুল কিন্তু ফুটছে। চাষিরা যথাসাধ্য শ্রম দিয়ে চেষ্টা করেছে, চাষাবাদ করেছে। সঠিক সময়ে পানিসেচ দেওয়া, সারা দেওয়া, বীজ বোপন- সবই করেছে। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। তারপরও কিছুটা ঘাটতি রয়ে গেছে। এখন বিজ্ঞানীরাও চেষ্টা করছেন জলবায়ুকে অনূকূলে আনতে। সেরকম যদি হয়, আর সরকার যদি উদ্যোগ নেয়, তাহলে নিশ্চয়ই ফের ফুলের ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াবে।’
বাংলাদেশের ফুল বিশ্বের অন্যান্য দেশে রফতানি করে অনেক অর্থ উপার্জিত হয়। তাই জলবায়ু ও আবহাওয়ার অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করাটাই এখন সময়ের দাবি ফুল চাষী ও ব্যবসায়ীদের।
সারাবাংলা/এফএন/পিটিএম