ঘরেই প্রাণ পাবে জাফরান, চাষে মিলবে সফলতা
৮ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:০০ | আপডেট: ৮ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:৩৭
ঢাকা: জাফরান। বিশ্বের সবচেয়ে দামি মসলার একটি। যে কারণে একে ‘রেড গোল্ড’ বা ‘লাল সোনা’ বলে অভিহিত করা হয়। প্রাচীনকাল থেকেই মসলা হিসেবে ও খাবারের রঙ সুন্দর করতে জাফরান ব্যবহার হয়ে আসছে। মূলত, বিরিয়ানি থেকে শুরু করে ঝাল ও মিষ্টি জাতীয় খাবারে জাফরান ব্যবহার করা হয়। এছাড়া, ওষুধ এবং রূপচর্চাতেও জাফরানের কদর রয়েছে। উন্নত মানের এক কেজি জাফরানের দাম সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার ডলার পর্যন্ত হতে পারে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ছয় লাখ টাকা।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যানুযায়ী বিশ্বের ৯০ ভাগ জাফরান উৎপাদিত হয় ইরানে। ইরান ছাড়াও ভারত, স্পেন, গ্রিস, মরক্কো, ইতালি, আজারবাইজান, তুরস্ক ও আফগানিস্তানে চাষ হয় এই মসলার। কিন্তু ভারতের কাশ্মীরে জাফরান কম বেশি চাষ হলেও প্রতিবেশী বাংলাদেশে এর উৎপাদন হয় না বললেই চলে। কারণ, জাফরান চাষের মূল শর্তই হলো তাপমাত্রা। দিনে ১৪ থেকে ২০ ডিগ্রি এবং রাতে তাপমাত্রা ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা জাফরান চাষের জন্য উপযোগী। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের তাপমাত্রা এরকমটি নয়।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
তবে এই মহামূল্যবান মশলা বাংলাদেশে চাষ সম্ভব কিনা- সে বিষয়ে গবেষণা করেছেন ঢাকার শেরে-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আ ফ ম জামাল উদ্দিন। সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মাটিতে খোলা জায়গায় জাফরান চাষ সফল না হলেও আলো-আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত কক্ষে জাফরানের ফুল ফোটানো সম্ভব।’ তিনি বলেন, ‘শীতপ্রধান এলাকাগুলোতে যেভাবে উন্মুক্ত পরিসরে জাফরানের চাষ হয়, সেই প্রচলিত পদ্ধতিতে বাংলাদেশে জাফরান উৎপাদন সম্ভব নয়। কারণ অত্যধিক বৃষ্টিপাতের কারণে মাটির নিচে করম (কন্দ) দ্রুত পচে যায়। আবার মাটির আর্দ্রতার কারণে গাছের ভালো বৃদ্ধি হলেও ফুল আসে না।’
অধ্যাপক জামাল উদ্দিন উল্লেখ করেন, ‘সাধারণত জাফরান চাষে বিস্তীর্ণ জায়গার দরকার হয়। কিন্তু আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি অ্যারোপনিক্স পদ্ধতিতে (বাতাসের মাধ্যমে গাছের খাদ্য উপাদান সরবরাহ) একটা ছোট আকারের ঘরের মধ্যেই এক হেক্টর সমপরিমাণ জায়গার জাফরান উৎপাদন করা সম্ভব। কারণ এই পদ্ধতিতে রোপণ করা গাছের ট্রেগুলো উলম্বভাবে সাজিয়ে রাখা হয়। এতে জায়গা লাগে কম। এছাড়া, ঘরে জাফরান চাষের ভালো দিকের মধ্যে আছে, এর ফলে রোগ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং নির্দিষ্ট সময়ে সেচ দেওয়া যায়। এ কারণে ভালো মানের জাফরান পাওয়া যায়।’
তিনি জানান, তাদের এই গবেষণায় টানা তিন বছর সফলতার সঙ্গে জাফরান চাষে সফল হয়েছে। কারণ, খোলা মাঠে যেসব দেশে জাফরান চাষ হয় তাতে তারা জমি থেকে একবারই ফসল নিতে পারে। কিন্তু ঘরের মাঝে জাফরান চাষ করলে বছরে তিন বার ফসল তোলা যায়। এই সফলতাকে পুঁজি করে বাংলাদেশে জাফরান চাষে লাভজনক বাণিজ্যিক উৎপাদন সম্ভব বলে মনে করছেন তিনি। দেশে যে কেউ জাফরান চাষে আগ্রহী হলে তাকে সহায়তা দেওয়া হবে বলে জানান আ ফ ম জামাল উদ্দিন।
ভারতে ঘরে জাফরান চাষ করে এরই মধ্যে অনেকেই লাভবান হয়েছেন বলে জানা গেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রমেশ গেরা নাম একজন ঘরে জাফরান চাষ করেন। তিনি বাড়ির একটি ঘরে কাশ্মীরের মতো ঠান্ডা আবহাওয়া তৈরি করেছেন। এছাড়া, নলিন গুপ্ত নামে এক চাষি কাশ্মীর থেকে প্রায় সাড়ে ৫০০ কিলোমিটার দূরে চণ্ডিগড়ে একটি কারখানা ভবনের বেসমেন্টে জাফরান চাষ করে সফল হয়েছেন। তিনি কয়েক বছর ধরে সেখানে জাফরান চাষ করছেন। নলিন গুপ্ত জানান, কাশ্মীরে এক একর জমিতে যে পরিমাণ জাফরান চাষ করা যায়, ঘরের চাষাবাদে সেইটা মাত্র ৭০০-৮০০ বর্গফুটেই পাওয়া সম্ভব। এতে পানি ও শ্রমিকের মতো বিষয়গুলো অনেক কম লাগে।
এদিকে জাফরান থেকে ফসল আসার পর গাছগুলোকে হিমঘর থেকে বের করে আবার মাটিতে লাগানো হয়- যেখানে সংখ্যা বাড়ে। অর্থাৎ একটি গাছ থেকে দুই থেকে পাঁচটি এবং কখনও কখনও একটি গাছ থেকে দশটি নতুন গাছও তৈরি হয়। যেহেতু, ভারতেও ঘরে জাফরান চাষ করে সফলতা এসেছে তাই যে কেউ উদ্যোগী হলে এই মসলাটা ঘরে চাষ করতে পারেন। এতে বাইরে থেকে জাফরান আমদানি কমে আসবে। আর তৈরির হবে রফতানির পথ।
জাফরানের ইতিবৃত্ত
১৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ব্রোঞ্জ যুগে গ্রিসের এজিয়ান দ্বীপপুঞ্জে গড়ে ওঠা মিনোয়ান সভ্যতায় প্রথম জাফরানের সন্ধান পাওয়া যায়। সেখানেই প্রথম জাফরানের ব্যবহার শুরু হয়। প্রায় ১৬০০ খ্রিষ্টপূর্বে সান্তোরিনি দ্বীপের ফ্রেস্কো ‘দ্য স্যাফ্রন গ্যাদারার্স’ চিত্রকর্মটিতে থাকা ক্রোকাস ফুল থেকে জাফরান চাষের ধারণা পাওয়া যায়। জানা গেছে, মিনোয়ানের অভিজাত নারীরা জাফরান দিয়ে রং করা একধরনের পোশাক পরতো। স্নানের পানি সুরভিত করতে রোমানরাও জাফরান ব্যবহার করতো। আবার প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে বর্তমান ইরাকের প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্রগুলোয় জাফরানের রং ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়াও, মিসরের সম্ভ্রান্ত নারীরা রূপচর্চায় জাফরান ব্যবহার করতেন বলে জানা গেছে। অনিন্দ্যসুন্দরী ক্লিওপেট্রা জাফরানমিশ্রিত দুধ দিয়ে গোসল করতেন।
জাফরান (বৈজ্ঞানিক নাম: Crocus sativus) হচ্ছে ক্রোকাস-ক্রোকাস গণের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদের প্রজাতি। জাফরান তৈরি হয় ক্রোকাস ফুলের গর্ভমুণ্ড থেকে। আর ক্রোকাস ফুল তুলতে হয় শরৎকালে। এই গাছ উচ্চতায় ৮ থেকে ১২ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। ফুলের তিনটি অংশ থাকে। প্রথমটি ক্রোকাস ফুলের কেন্দ্রে থাকা লাল গর্ভমুণ্ড, যেটা দিয়ে জাফরান তৈরি হয়। দ্বিতীয় অংশ ফুলের পুংকেশর বা স্টামেন। আর তৃতীয়টি হলো ফুলের পাপড়ি। কাপড় রঙ করার জন্য ফুলের পাপড়ি ব্যবহার করা হয়। ক্রোকাস ফুল মাত্র কয়েকদিনের জন্য ফোটে। এই ফুল সকালে তুলতে হয়। হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনীর সাহায্যে খুব সতর্কতার সঙ্গে ফুলের গর্ভমুণ্ড সংগ্রহ করতে হয়, যেন এটা ভেঙে না যায়। এরপর গর্ভমুণ্ড রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। এক কেজি জাফরান সংগ্রহ করতে প্রায় দেড় লাখ ফুল থেকে ২০ দিন ধরে গর্ভমুণ্ড সংগ্রহ করতে হয়। আর ফুল থেকে থেকে জাফরান বের করতে বেশ দক্ষতার প্রয়োজন। এ কারণেই জাফরানের দাম আকাশছোঁয়া।
জাফরানের যত গুণ
রান্না ছাড়াও জাফরান ঔষধি গুণাবলীর জন্য বেশ পরিচিত। ইরানের সরকারি ‘ভিজিট আওয়ার ইরান’ ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, জাফরানের সবচেয়ে সুপরিচিত ঔষধি ব্যবহারগুলোর মধ্যে একটি হলো বিষণ্নতা ও উদ্বেগ কমানো। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, জাফরান মস্তিষ্কে নিউরোট্রান্সমিটারের মাত্রা বিশেষ করে সেরোটোনিন, ডোপামিন এবং নোরেপাইনফ্রিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট প্রভাব ফেলতে পারে। এর অর্থ হলো জাফরান বিষণ্নতা ও উদ্বেগ কমিয়ে প্রশান্তি এনে দিতে পারে। এছাড়া, জাফরান হৃদরোগে বেশ কার্যকর। গবেষণা থেকে জানা গেছে, জাফরান রক্তচাপ কমাতে ও কোলেস্টেরলের মাত্রা উন্নত করতে এবং হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এমনকি জাফরান ত্বকের উজ্বলতা বৃদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি বাড়াতেও দারুণ কার্যকর। মূলত জাফরান হলো প্রাকৃতিক ওষুধ।
সারাবাংলা/এনএল/পিটিএম