মার্চ ফর গাজার ঘোষণাপত্র
জায়নবাদীদের পণ্য বর্জন-ফিলিস্তিনিদের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার আহ্বান
১২ এপ্রিল ২০২৫ ১৯:১৭ | আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২৫ ২১:৩২
ঢাকা: ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলা ও গণহত্যার প্রতিবাদে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচি দিয়েছে ‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট বাংলাদেশ’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম।
এই কর্মসূচির ঘোষণাপত্র ও অঙ্গীকারনামা পাঠ করেছেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। ঘোষণাপত্রে ইসরায়েলের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে মুসলিম বিশ্বের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এ ছাড়া জায়নবাদীদের পণ্য বর্জন ও ফিলিস্তিনিদের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার আহ্বান জানানো হয়।
শনিবার (১২ এপ্রিল) রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত কর্মসূচির মূল মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি ফিলিস্তিনের সমর্থনে এ ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।

মূল মঞ্চে আজহারী, শায়খ আহমাদুল্লাহ ও হাসনাত আব্দুল্লাহসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। ছবি: সারাবাংলা
ঘোষণাপত্রে বলা হয়:
আজ আমরা, বাংলাদেশের জনতা— যারা জুলুমের ইতিহাস জানি, প্রতিবাদের চেতনা ধারণ করি— সমবেত হয়েছি গাজার শহিদদের পাশে দাঁড়াতে। আজকের এই সমাবেশ কেবল প্রতিবাদ নয়, এটি ইতিহাসের সামনে দেওয়া আমাদের জবাব, একটি অঙ্গীকার, একটি শপথ।
পদযাত্রা ও গণজমায়েত থেকে চারটি স্তরে দাবিগুলো উপস্থাপন করা হয়। আমাদের প্রথম দাবিগুলো জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি ঘোষণা যেহেতু— জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সকল জাতির অধিকার রক্ষার, দখলদারিত্ব ও গণহত্যা রোধের সংকল্প প্রকাশ করে; এবং আমরা দেখেছি, গাজায় প্রতিদিন যে রক্তপাত, যে ধ্বংস চলছে, তা কোনো একক সরকারের ব্যর্থতা নয় বরং এটি একটি আন্তর্জাতিক ব্যর্থতার ফল; এবং এই ব্যর্থতা শুধু নীরবতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং পশ্চিমা শক্তিবলয়ের অনেক রাষ্ট্র সরাসরি দখলদারকে অস্ত্র, অর্থ ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে এই গণহত্যাকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে; এবং— এই বিশ্বব্যবস্থা দখলদার ইজরায়েলকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে বরং রক্ষা করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে; সেহেতু আমরা জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি বলছি:
- জায়নবাদী ইজরায়েলের গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে নিশ্চিত করতে হবে।
- যুদ্ধবিরতি নয়— গণহত্যা বন্ধে কার্যকর ও সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
- ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী ভূমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে হবে।
- পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
- ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা, এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করতে হবে। কারণ এই মুহূর্তে বিশ্বব্যবস্থা যে ন্যায়ের মুখোশ পরে আছে, গাজার ধ্বংসস্তূপে সেই মুখোশ নিলজ্জভাবে খুলে পড়ে গেছে।
আমাদের দ্বিতীয় দাবিগুলো মুসলিম উম্মাহর নেতৃবৃন্দের প্রতি। যেহেতু আমরা বিশ্বাস করি, ফিলিস্তিন কেবল একটি ভূখণ্ড নয় এটি মুসলিম উম্মাহর আত্মপরিচয়ের অংশ। গাজা এখন কেবল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর নয় এটি আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। উম্মাহর প্রতিটি সদস্য, প্রতিটি রাষ্ট্র, এবং প্রতিটি নেতৃত্বের ওপর অর্পিত আছে সেই আমানত যা আল্লাহ প্রদত্ত ভ্রাতৃত্ব ও দায়িত্বের সূত্রে আবদ্ধ। ইজরায়েল একটি অবৈধ, দখলদার, গণহত্যাকারী রাষ্ট্র যা মুসলিমদের প্রথম কিবলা ও একটি পুরো জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করতে উদ্যত হয়েছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদ আজ এই অঞ্চলে জায়নবাদী প্রকল্পের প্রতিবিম্বে পরিণত হয়েছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত দমন-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতে সম্প্রতি ওয়াকফ সম্পত্তি আইন সংশোধনের মাধ্যমে মুসলিমদের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক স্বত্বাধিকার হরণ করা হয়েছে যা উম্মাহর জন্য একটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা।
সেহেতু—আমরা মুসলিম বিশ্বের সরকার ও ওআইসি’র মত বহুজাতিক সংগঠনগুলোর নিকট দৃঢ়ভাবে আহ্বান জানাই:
- ইজরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সকল সম্পর্ক অবিলম্বে ছিন্ন করতে হবে।
- জায়নবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।
- গাজার মজলুম জনগণের পাশে সর্বাত্মক সহযোগিতা নিয়ে দাঁড়াতে হবে, চিকিৎসা, খাদ্য, আবাসন ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ।
- আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইজরায়েলকে এক ঘরে করতে সক্রিয় কূটনৈতিক অভিযান শুরু করতে হবে।
- জায়ানাবাদের দোসর ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসনের অধীনে মুসলিমদের অধিকার হরণ, বিশেষ করে ওয়াকফ আইন সংশোধনের মতো রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ওআইসি ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে দৃঢ় প্রতিবাদ ও কার্যকর কূটনৈতিক অবস্থান নিতে হবে।
কারণ গাজার রক্তে লজ্জিত হওয়ার আগেই, গাযার পাশে দাঁড়ানোই উম্মাহর জন্য সম্মানের একমাত্র পথ। এবং যে নেতৃত্ব আজ নিরব, কাল ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য হবে।
আমাদের তৃতীয় দাবিগুলো বাংলাদেশ সরকারের প্রতি- যেহেতু বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র, যার স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তিতেই নিহিত রয়েছে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চেতনা। আমরা বিশ্বাস করি, ফিলিস্তিনের প্রশ্নে বাংলাদেশ কেবল মানবতার নয় ঈমানের পক্ষেও এক ঐতিহাসিক অবস্থানে আছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে সরকারের দায়িত্ব, জনগণের ঈমানি ও নৈতিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা রাখা। বাংলাদেশের জনগণ গাজার পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে, তাই রাষ্ট্রের ও দায়িত্ব জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া।
সেহেতু—আমরা বাংলাদেশের সরকারের প্রতি দৃঢ়ভাবে আহ্বান জানাই:
- বাংলাদেশি পাসপোর্টে ‘Except Israel’ শর্ত পুনর্বহাল করা, ইজরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার অবস্থান আরও সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে হবে।
- সরকারের ইসরায়েলি যত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যত চুক্তি হয়েছে, তা বাতিল করতে হবে।
- রাষ্ট্রীয়ভাবে গাজায় ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা পাঠানোর কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
- সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং আমদানি নীতিতে জায়নবাদী কোম্পানির পণ্য বর্জনের নির্দেশনা দিতে হবে।
- জায়ানাবাদের দোসর ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকারের অধীনে মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান নির্যাতনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবাদ জানাতে হবে, যেহেতু হিন্দুত্ববাদ আজ শুধু একটি স্থানীয় মতবাদ নয়—বরং আন্তর্জাতিক জায়নিস্ট ব্লকের অন্যতম দোসর।
- পাঠ্যবই ও শিক্ষা নীতিতে আল-আকসা, ফিলিস্তিন, এবং মুসলিমদের সংগ্রামী ইতিহাসকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মুসলিম আত্মপরিচয়ের সঙ্গে গড়ে ওঠে।
কারণ— রাষ্ট্র কেবল সীমানা নয়, রাষ্ট্র এক আমানত। আর এই আমানত রক্ষা করতে না পারলে ইতিহাস কাউকেই ক্ষমা করে না।
আমাদের সর্বশেষ দাবিগুলো নিজেদের প্রতি যা মূলত একটি অঙ্গীকারনামা যেহেতু আমরা বিশ্বাস করি, আল-কুদস কেবল একটি শহর নয়, এটি ঈমানের অংশ। আমরা জানি, বাইতুল মাকদিসের মুক্তি অন্য কারো হাতে নয়—আমাদেরই কোনো প্রজন্মের হাতে তা লেখা হবে। আমরা বুঝি, জায়নবাদ কেবল বাইরের দখলদার নয় এটি ভেতরের আত্মবিস্মৃতির সুযোগে দাঁড়ায়। আজ যদি আমরা প্রস্তুত না হই, কাল আমাদের সন্তানেরা হয়তো এমন এক বাংলাদেশ পাবে যেখানে হিন্দুত্ববাদ ও জায়নবাদ একত্রে নতুন গাজা তৈরি করবে। এবং গাজা আমাদের জন্য এক আয়না, যেখানে আমরা দেখতে পাই, কীভাবে বিশ্বাসী হওয়া মানে কেবল বেঁচে থাকা নয়, সংগ্রামে দৃঢ় থাকা।
সেহেতু—আমরা এই মাটির মানুষ, এই মুসলিমবঙ্গের নাগরিক, এই কওমের সন্তান একটি অঙ্গীকার করছি:
- আমরা বয়কট করব, প্রত্যেক সেই পণ্য, কোম্পানি ও শক্তিকে যারা ইজরায়েলের দখলদারিত্বকে টিকিয়ে রাখে।
- আমরা আমাদের সমাজকে প্রস্তুত করব, এমন নুরউদ্দীন, এমন সালাহউদ্দিন তৈরি করার জন্য, যারা বাইতুল মাকদিসের মিম্বার পুনরুদ্ধার করবে, ইনশাআল্লাহ।
- আমরা আমাদের সন্তানদের এমনভাবে গড়ে তুলব যারা নিজেদের আদর্শ ও ভূখণ্ড রক্ষায় জান ও মালের সর্বোচ্চ ত্যাগে প্রস্তুত থাকবে।
- আমরা বিভাজিত হবো না, কারণ আমরা জানি, বিভক্ত জনগণকে দখল করতে দেরি হয় না। আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব, যাতে এই বাংলাদেশ কখনো কোনো হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পের পরবর্তী গাজায় পরিণত না হয়। আমরা শুরু করব নিজেদের ঘর থেকে ভাষা, ইতিহাস, শিক্ষা, অর্থনীতি, সমাজ, সবখানে এই অঙ্গীকারের ছাপ রেখে। আমরা মনে রাখবো: গাজার শহীদরা কেবল আমাদের দো‘আ চান না, তারা আমাদের প্রস্তুতি চান।
মাহমুদুর রহমান বলেন, শান্তি বর্ষিত হোক গাজার সম্মানিত অধিবাসীদের ওপর, যারা সবর করেছেন, যারা ঈমানের প্রমাণ দিয়েছেন। যারা ধ্বংসস্তূপের মাঝেও প্রতিরোধের আগুন জ্বেলেছেন বিশ্বের নীরবতা ও উদাসীনতার যন্ত্রণা হাসিমুখে বুকের মাঝে ধারণ করেছেন।

মার্চ ফর গাজায় হাজারো মানুষের ভীড়। ছবি: সারাবাংলা
তিনি বলেন, শান্তি বর্ষিত হোক হিন্দ রজব, রীম, ফাদি আবু সালেহ এবং মুহাম্মাদ আল-দুরাদের ওপর, যাদের রক্তে আকাশ রঙিন হয়েছে, যাদের চোখে ছিল প্রতিরোধের দীপ্তি। শান্তি বর্ষিত হোক বাইতুল মাকদিসের গর্বিত অধিবাসীদের উপর, যাঁদের হৃদয়ে এখনো ধ্বনিত হয় ‘আল-কুদস লানা’।
তিনি আরও বলেন, গাজার জনগণকে অভিনন্দন, আপনারা ঈমান, সবর আর কুরবানীর মহাকাব্য রচনা করেছেন। দুনিয়াকে দেখিয়েছেন ঈমান আর তাওয়াক্কুলের শক্তি। আমরা, বাংলাদেশের মানুষ শাহ জালাল আর শরীয়াতুল্লাহর ভূমি থেকে দাঁড়িয়ে, আপনাদের সালাম জানাই, আপনাদের শহিদদের প্রতি ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা জানাই, আর আমাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় এই দো‘আ, হে আল্লাহ, গাজার এই সাহসী জনপদকে তুমি সেই পাথর বানাও, যার উপর গিয়ে ভেঙে পড়বে সব জায়োনিস্টদের ষড়যন্ত্র।
সারাবাংলা/ইউজে/এইচআই