Saturday 12 Apr 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জুলাই আন্দোলনে দমন-পীড়ন
অভ্যুত্থানের পর গা ঢাকা দিলেও ফের সরব হচ্ছেন ঢাবির কিছু শিক্ষক

মেহেদী হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১২ এপ্রিল ২০২৫ ২২:২৬

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: গতবছরের জুলাই আন্দোলনের সরাসরি বিরোধিতা করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক। শুধু বিরোধিতা নয়, ছাত্র-জনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে সভা-সমাবেশও করেছেন তারা। যেগুলোর ছবি ও ভিডিও গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। এছাড়া, আওয়ামী লীগ আমলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্য ও পদোন্নতি; অন্য শিক্ষকদের পদোন্নতি স্থগিত করে তাদের কোণঠাসা করে রাখাসহ অনেক কিছুর-ই অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। যদিও এইসব শিক্ষক জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর গা ঢাকা দিয়েছিল; কিন্তু এখন ফের সরব হয়েছে ক্যাম্পাসে।

বিজ্ঞাপন

অভিযোগ ওঠা উল্লেখযোগ্য শিক্ষকরা হলেন- অধ্যাপক লিটন কুমার সাহা (ফলিত গণিত বিভাগ), অধ্যাপক জাভীদ ইকবাল বাঙালী (ফলিত গণিত বিভাগ), ড. মো. আব্দুস সামাদ (সাবেক ডিন, ফলিত গণিত বিভাগ) এবং অধ্যাপক আসিফ হোসাইন খান (কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ)। কিন্তু তারা এখনো শিক্ষক পদে বহাল রয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত (যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য) অধ্যাপক জাভীদ ইকবাল বাঙালী। এছাড়া, অধ্যাপক লিটন কুমার সাহা, ড. মো. আব্দুস সামাদ, আসিফ হোসাইন আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয়ে সবসময় তৎপর ছিলেন। জুলাই আন্দোলনে যেসব শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এসব শিক্ষক সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। আর আওয়ামী লীগের আমলে প্রভাব খাটিয়ে নিয়োগ বাণিজ্য ও পদোন্নতির ব্যবস্থা করতেন জাভীদ ইকবাল বাঙালী ও লিটন কুমার। ফলে যোগ্য শিক্ষকরা পদোন্নতি বঞ্চিত ছিলেন দীর্ঘদিন।

এর আগে জুলাই আন্দোলনের সরাসরি বিরোধিতা করায় জড়িত শিক্ষকদের স্থায়ী বহিষ্কারের আবেদন জানায় ঢাবির ফলিত গণিত বিভাগের শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ, ফলিত গণিত বিভাগের শিক্ষক ড. মো. জাভীদ ইকবাল বাঙালী, ড. লিটন কুমার সাহা ও ড. মো. আব্দুস সালাম শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনের সরাসরি বিরোধিতা করেছেন। এছাড়া, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো হত্যাকাণ্ড ও হামলার বিষয়ে নীরব থেকে স্বৈারচারের পক্ষে বিভিন্ন র‌্যালি ও সমাবেশে অংশ নিয়েছেন। তারা এই শিক্ষকদের চাকরি থেকে স্থায়ী বহিষ্কারের দাবি জানায়।

যদিও শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ফলিত গণিত বিভাগের ডিনের পদ থেকে ড. মো. আব্দুস সামাদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেলের পরিচালক পদ থেকে অধ্যাপক আসিফ হোসাইন খান পদত্যাগ করেন। কিন্তু বিভাগটিতে তারাসহ অভিযুক্ত অন্যান্য শিক্ষকরা এখনো দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক সারাবাংলাকে বলেন, ‘জুলাই পরবর্তী শিক্ষার্থীরা শিক্ষক লিটন কুমারকে বয়কট করে তার পদত্যাগের জন্য আন্দোলন করেছিল। সে সময় তিনি গা ঢাকা দেন। কিন্তু কিছুদিন যেতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ফের সরব হয়েছেন। তিনি ফলিত গণিত বিভাগে পদ-পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে অধ্যাপক পদে পদোন্নতিতে আওয়ামী দালালির সুযোগ নিয়েছেন, যা ঢাবিতে বিরল। তিনি নিজের শিক্ষককে পেছনে ফেলে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেনম যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককদের মর্মাহত ও হতাশ করে। আওয়ামী লীগের আমলে তিনি কাউকে পরোয়া করতেন না। এমনকি, কর্মচারীদের চাকরি দেখে নেওয়ারও হুমকি দিতেন তিনি।’

শিক্ষকরা আরও বলেন, ‘জাভীদ ইকবাল বাঙালী বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত বিভাগগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে নিজের পছন্দ মতো প্রার্থীর জন্য ডিন ও তৎকালীন উপ-উপাচার্য এবং পরবর্তীতে ভিসি অধ্যাপক মাকসুদ কামালের সঙ্গে প্রার্থীদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে সুপারিশ করতেন। তার ভয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পেত না। তিনি আওয়ামী লীগের শিক্ষকদের সমন্বয়ে দল-বল নিয়ে চলাফেরা করতেন। সেইসঙ্গে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের প্রশাসনিকভাবে নানারকম হয়রানি করে প্রভাব বিস্তার করতেন।’

জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ফুটেজ সংগ্রহ করে ছাত্রলীগ ও পুলিশকে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেলের সদ্য সাবেক পরিচালক অধ্যাপক আসিফ হোসাইন খানের বিরুদ্ধে। এমনকি এ জন্য তিনি ৪০ হাজার টাকায় চারটি হার্ডডিস্কও কিনেছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

এই অভিযোগের বিষয়ে অধ্যাপক আসিফ হোসাইন খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি এই বিভাগে সাত বছর ধরে কাজ করেছি। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে সেটি রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এর আসলে কোনো ভিত্তি নাই। সিসি টিভির ফুটেজে প্রক্টোরিয়াল বডির ও এই বিভাগের কিছু কর্মচারীর এক্সসেস থাকে। তাদের থেকে যদি কেউ নেয়, সেই দায়ভার তো আমি নিতে পারি না। কর্তৃপক্ষের দুই দফায় চারটি হার্ডডিস্ক দরকার হয়েছিল, সেটি কিনে দেওয়া হয়। অভিযোগ আসার পর আমি আমার স্বচ্ছতা যাচাইয়ের তদন্তের জন্য চিঠিও দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘আমি আসলে ফেঁসে গিয়েছি।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে অধ্যাপক জাভীদ ইকবাল বাঙালীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নাই।’ অভিযুক্ত শিক্ষক অধ্যাপক লিটন কুমার সাহার সঙ্গে এই প্রতিবেদক মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি কল রিসিভ করে প্রশ্নটি শোনেন। কিন্তু তারপর কোনো উত্তর দেননি।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা সারাবাংলাকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের যদি সুনির্দিষ্ট আনুষ্ঠানিক লিখিত কোনো অভিযোগ থাকে সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যথার্থ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে। তাদের অভিযোগ আমলে নিয়ে যদি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করতে হয়, সেটিও করা হবে। শুধু ফলিত গণিত বিভাগই নয়, যেকোনো বিভাগ থেকে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ এলে গুরুত্বসহ নিয়মের আওতায় যা করা দরকার আমরা করব। এর আগেই আমরা করেছি, এখনো করব।’

তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের পর এসব বিষয়ে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আমরা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পেয়েছি। সেগুলো আমলে নিয়ে আমরা ধাপে ধাপে সমাধানে আসার জন্য কাজ করছি। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হয়েছে। এই যেমন- অভিযুক্ত শিক্ষককে ক্লাস নিতে দেওয়া হয়নি, বা একধরনের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। তারপরও আরও বেশকিছু বিভাগ ও অনুষদে আমরা তথ্য অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছি। এই কমিটিতে বিভাগের ডিন ও প্রক্টোরিয়াল বডির একজন সদস্যকে রাখার চেষ্টা করেছি।’

কমিটি স্বাধীনভাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও আরও যারা আছে সবার সঙ্গে কথা বলেছে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনেকগুলো কমিটি তাদের কাজ শেষ করে রিপোর্ট জমা দিয়েছে। এর ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে বলে জানান অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা।

সারাবাংলা/এমএইচ/পিটিএম

ক্যাম্পাস জুলাই অভ্যুত্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিরোধিতা সরব