নববর্ষ পালনে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর উস্কানির প্রতিবাদ ১৮ বিশিষ্ট নাগরিকের
১৩ এপ্রিল ২০২৫ ১৩:২৭ | আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:৫২
ঢাকা: বাংলা নববর্ষ পালনে ঐতিহ্যগত নানা আয়োজন ও অনুষ্ঠান নিয়ে সম্প্রতি এক শ্রেণীর উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী যে বিতর্ক সৃষ্টি ও উস্কানির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে- এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশের ১৮ জন বিশিষ্ট নাগরিক।
রোববার (১৩ এপ্রিল) গণমাধ্যমে এ বিবৃতি পাঠানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা তীব্র ক্ষোভ ও গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, গত কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক মিডিয়ায় কিছু উগ্র সাম্প্রদায়িক মহল আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ পহেলা বৈশাখ নববর্ষ পালন এবং এর বিভিন্ন অনুষ্ঠান নিয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টির উছিলা খুঁজে বেড়াচ্ছে। বর্ষ বরণের শোভাযাত্রায় কী ধরণের পোশাক পরা যাবে, কী ধরণের প্ল্যাকার্ড বহন করা যাবে কিংবা যাবে না- এসব নিয়ে অযাচিত অনধিকার চর্চার ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য ও বিবৃতি দিয়ে চলেছেন। তাদের এই সকল বিবৃতি ও উগ্র আচরণের হুঙ্কার গত পঞ্চাশ-ষাটের দশকে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর সেবাদাস উগ্র সাম্প্রদায়িক মহলের সন্ত্রাসী আচরণের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। পয়লা বৈশাখকে ঘিরে যে সকল সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উৎসব হয়, তা আমাদের জাতীয় ঐক্য ও সংহতি প্রকাশের এক মহা আয়োজন। এই আয়োজনকে কলঙ্কিত বা বাধাগ্রস্ত করার কোন অধিকার কারো নেই।”
বিবৃতিতে বলা হয়, “এ দেশের আপামর জনগণ দলমত নির্বিশেষে বহু সংগ্রাম এবং সর্বশেষ ’৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ওই সকল ধর্মব্যবসায়ী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সকল অপচেষ্টা পরাজিত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিল। গত ২০২৪ সালের জুলাই ছাত্র-জনতার অভুত্থানের মধ্যদিয়ে আমরা নিষ্ঠুর কর্তৃত্ববাদী, গণহত্যাকারী লুটেরা সরকারকেও উৎখাত করে জবাবদিহিমূলক সুশাসন, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং অসাম্প্রদায়িক ও ন্যায় বিচার ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগের জন্য স্ব স্ব অবস্থান থেকে উদ্যোগী হয়েছি। এ সময় পহেলা বৈশাখ নববর্ষ পালনের অনুষ্ঠান নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি কিংবা এর কোন অনুষ্ঠানের ওপর অযাচিত বিধি-নিষেধ আরোপে মহল বিশেষের অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রচেষ্টা কোনভাবেই কাম্য নয়। আমরা ওইসব মহলের উগ্র সাম্প্রদায়িক বিবৃতি এবং উস্কানিমূলক বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। একই সাথে অন্তবর্তী সরকার এবং বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং আইন শৃংখলার দায়িত্বে নিয়োজিত সকল প্রতিষ্ঠানের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি যে, পহেলা বৈশাখ স্বাধীন ও সুশৃঙ্খলভাবে পালনে বাধাদান কিংবা উস্কানিমূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত ব্যক্তি, মহল ও সংগঠনগুলোকে যে কোন ধরণের অপতৎপরতা থেকে বিরত রাখতে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।”
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, “পহেলা বৈশাখ পালন যেমন কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, তেমনি তার সঙ্গে ধর্ম বিশ্বাসের সংঘাত নেই। মোগল সম্রাট আকবরের শাসন আমল থেকে এই জনপদের ধর্ম-বর্ণ- নির্বিশেষে সকল মানুষ শত শত বছর ধরে এই উৎসব পালন করে এসেছে। একে বিতর্কিত করার কোন অবকাশ নেই। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামের মধ্যে ধর্মীয় বিদ্বেষ খোঁজা- সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর অপচেষ্টারই নামান্তর। আর তাদের প্রশ্রয় দিয়ে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে উদাহরণ সৃষ্টি করলেন- তা প্রশ্নবিদ্ধ ও নিন্দনীয়।”
বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী বাংলাভাষাভাষীরা যে সময় বাংলা নববর্ষ পালন করি, একই সময় জুড়ে বিভিন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বিজু, সাংগ্রাইং, বৈসু, বিহু, বিষু, চানক্রান, সাংলান, সাংগ্রাই প্রভৃতি উৎসব নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালন করে থাকেন। আদিবাসীদের উপস্থিতি যেমন অন্তর্ভুক্তিমূলক কাজের অংশ, তেমনি তাদের আদিবাসী পরিচয়ের অস্বীকৃতি তাদের প্রতি সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য প্রণোদিত অবহেলারই নজিরমাত্র।”
বিবৃতিতে বলা হয়, “উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এবং অন্যান্য মহলের উস্কানিমূলক বক্তব্যের প্রতিবাদে ইতোমধ্যেই এক সংবাদ সম্মেলনে ৫ দফা দাবি জানিয়েছে জাতীয় কবিতা পরিষদ। তাদের সেসব দাবির প্রতি আমরা দৃঢ় সমর্থন ও সংহতি জ্ঞাপন করছি।”
বিবৃতিতে সই করেন- মানবাধিকার কর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, বেসরকারি সংস্থা নিজেরা করি এর সমন্বয়কারী খুশী কবির, টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, সেন্ট্রাল উইমেন ইউনিভার্সিটি’র ভাইস চ্যান্সেলর ড. পারভীন হাসান,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা, ড. জোবাইদা নাসরীন, ড. খাইরুল চৌধুরী, সহযোগী অধ্যাপক তাসনীম সিরাজ মাহবুব, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও আসক চেয়ারপারসন জেড আই খান পান্না, সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এড. সুব্রত চৌধুরী, সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী এড. তবারক হোসেইন, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী এড. মিনহাজুল হক চৌধুরী, লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ, বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ট্রাস্ট এর নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনিন্দ্র কুমার নাথ, মানবাধিকার কর্মী সাঈদ আহমেদ ও আদিবাসী অধিকার কর্মী হানা শামস আহমেদ।
সারাবাংলা/এফএন/আরএস