ঢাকা: মেঘনা আলম। সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়ার পর ভাইরাল একটি নাম। ‘মিস আর্থ’খ্যাত এই মডেলকে ঘিরে এখন আলোচনা ও সমালোচনা তুঙ্গে। আলোচনার আরেকটি কারণও রয়েছে। বলা হচ্ছে, তার গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের চৌকস এক কর্মকর্তাকে ‘বলির পাঠা’ হতে হলো। অভিযোগ উঠেছে, গুলশান এলাকা ও কূটনীতিক পাড়ায় এই মেঘনা আলমের যাতায়াত বেশ আগে থেকেই। তিনি বিভিন্ন কূটনীতিকের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে ট্রাপে ফেলতেন। একটি চক্রের হয়ে কাজ করছিলেন মডেল মেঘনা। রাষ্ট্রদূতসহ বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যক্তিকে ফাঁসিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করাই ছিল ওই চক্রটির মূল উদ্দেশ্য।
সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসা বিন ইউসুফ আল দুহাইলানের কাছে পাঁচ মিলিয়ন ডলার দাবি করেছিলেন। কিন্তু ওই রাষ্ট্রদূত দুই মিলিয়ন ডলার দিতে রাজি হন। তবে মেঘনা আলম তাতে সায় দেয়নি। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে ওই রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। যাওয়ার আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মেঘনার নামে লিখিত অভিযোগ দিয়ে যান। এর পর তদন্তে নেমে ডিবি পুলিশ মেঘনা আলমকে গ্রেফতার করে।
এদিকে মেঘনাকে গ্রেফতারের পর শনিবার (১২ এপ্রিল রাতে) ডিএমপি কমিশনারের এক আদেশে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিককে ডিবি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তিনি এখন ডিএমপি সদর দফতরে সংযুক্ত রয়েছেন। সরকারি কয়েকটি সূত্র বলেছে, রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে অভিযোগ দেওয়ার পর পুলিশ ও সরকারের একাধিক সংস্থার কর্মকর্তারা দফায় দফায় মেঘনা আলমের সঙ্গে কথা বলেন। তারা জানার চেষ্টা করেন, ঢাকায় বিদেশি কূটনৈতিক মহলে কার কার সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। সৌদি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তার কোনো ভিডিও আছে কি না।
এ ছাড়া, সৌদি আরবে বাংলাদেশের প্রায় ২৫ লাখ শ্রমিকের উপস্থিতি, বড় শ্রমবাজারসহ বিভিন্ন কারণে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের গুরুত্বের দিকগুলো বিবেচনায় নিয়ে রাষ্ট্রদূত ঈসার বিষয়টি থেকে তাকে (মেঘনা) সরে আসার অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু মেঘনা কোনো প্রকার সহযোগিতা করতে রাজি না হননি। পরে পুলিশ তাকে আদালতে সোপর্দ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ডিবি পুলিশের তদন্তে জানা যায়, কারাগারে আটক থাকা মেঘনা আলম বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসা বিন ইউসুফ আল দুহাইলানের কাছ থেকে পাঁচ মিলিয়ন ডলার দাবি করেছিল। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দর কষাকষি হয়। এক পর্যায়ে ওই রাষ্ট্রদূত দুই মিলিয়ন ডলার দিতে রাজি হন। কিন্তু মেঘনা আলম কিছুতেই রাজি হয়নি। এমনকি অন্য একটি পক্ষ বারবার বোঝানোর পরও পাঁচ মিলিয়ন ডলার থেকে সরে আসেননি। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে ওই রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেন।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, অন্তবর্তী সরকারের উচ্চপদে থাকা একজন মেঘনাকে গ্রেফতারের দিন (৯ এাপ্রিল) থেকেই ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি বলে আসছেন। তিনি আইজিপি বাহারুল আলম ও ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীকে বিষয়টি দেখার অনুরোধ করেন। এ ছাড়া, ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিককে বারবার চাপ দিয়ে আসছিলেন। যাতে তিনি মেঘনাকে সসম্মানে ছেড়ে দেন। কিন্তু রেজাউল করিম মল্লিক তার অন্যায় আবদারে সায় দেননি। তিনি আইনের মধ্যে থেকেছেন। আর এতেই কাল হলো তার। ওই উচ্চপদে থাকা ব্যক্তি একজন উপদেষ্টাকে দিয়েও আইজিপিকে ফোন করান। এর পর কমিশনার ডিবির এই কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেন।
ডিবির অতিরিক্ত কশিনার রেজাউল করিম মল্লিককে অন্যায়ভাবে সরানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর পুলিশ যখন নিস্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিল, যখন বাড়ছিল অরাজকতা, তখন ডিবির হাল ধরেন এই রেজাউল মল্লিক। তিনি কয়েকশ’ আওয়ামী লীগ নেতা ও জুলাই অভ্যুত্থানে হায়েনারূপী অনেককে গ্রেফতার করান। ঢাকা মহানগরীতে যখন ছিনতাই-চাঁদাবাজি নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে যাচ্ছিল তখন ডিবির এই কর্মকর্তার নেতৃত্বেই শুরু হয় অভিযান। একটা সময় সবকিছু থেমে যায় এবং মানুষ শান্তিতে রোজা শেষে ঈদ উযযাপন করে। ফলে এবারের ঈদ ছিল সর্বকালের স্বস্তির।
গোয়েন্দা পুলিশের ভেতরের কর্মকর্তারাই বলছেন, ডিবির এই কর্মকর্তা না থাকলে চিন্ময় কুমার দাসকে গ্রেফতার করা সম্ভব হতো না। হাজারো চাপ থাকার পরও চিন্ময় কুমার দাসকে গ্রেফতার করেছেন তিনি। ভারতীয় দূতাবাসের একাধিক ফোন কল পাওয়ার পরও চিন্ময় দাসকে ছেড়ে দেননি। এমনকি চিন্ময় কুমার দাসকে গ্রেফতারের কারণে ডিবি কর্মকর্তা রেজাউলের পরিবার ঠিক মতো বাইরে ঘুরতে পারেন না। তার ছেলেমেয়েরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও যেতে ভয় পান। সবসময় আতঙ্কে দিন পার করতে হচ্ছে। অথচ সামান্য এক মডেলকে গ্রেফতারের কারণে সরিয়ে দেওয়া হলো রেজাউলকে। এর ফলে ডিবিতে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এখন কোনো কর্মকর্তা আর এরকম গ্রেফতারে সাহস দেখাতে যাবে না। তখন একটি পক্ষ হয়তো সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে বলে অভিযোগ করেন একাধিক ডিবি কর্মকর্তা।
আরও অভিযোগ উঠেছে, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ওই ব্যক্তি এর আগেও টেকনাফের আলোচিত ওসি প্রদীপ কুমারকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। ওসি প্রদীপ কুমার মেজর সিনহাকে গুলি করে হত্যার পর প্রথম যাকে ফোন করে বলেছিলেন, আমি তো গুলি করে দিয়েছি, এখন আমি কী করব, আমাকে বাঁচান। ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা ব্যক্তিটি নাকি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ওই ব্যক্তিটি। তিনি কীভাবে সরকারের এই বড় একটা পদে গেলেন তা নিয়ে রীতিমতো সমালোচনা শুরু হয়েছে।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, এভাবে একজন বিশ্বস্ত পুলিশ অফিসারকে বলির পাঠা বানালে আবারও ভেঙে পড়তে পারে পুলিশের চেইন অব কমান্ড। কমান্ড বাস্তবায়নে যারা কাজ করেন তারাও ভয়ে থাকবেন। ফলে কাজের চেয়ে অকাজই বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তারা। তাই অবিলম্বে রেজাউল করিম মল্লিককে স্বপদে ফিরিয়ে দিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বললেন তারা।