স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধ, পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া
১৬ এপ্রিল ২০২৫ ২২:৪৯ | আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২৫ ০৫:১৯
ঢাকা: ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধ হয়েছে। এতে দেশের পোশাক খাতের ছোট উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। দ্রুত সময়ের জন্য (স্বল্প লিড টাইম) পাওয়া ক্রয়াদেশ (অর্ডার) ধরতে না পারায় রফতানি আয়েও পড়বে নেতিবাচক প্রভাব। আর বিকল্পপথে সুতা আমদানি কিংবা দেশ থেকে সুতা কিনতে খরচ বাড়লে প্রতিযোগিতায় টিকতেও তাদের বেগ পেতে হবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ভুল হিসেবে দেখছেন পোশাক খাতের বেশ কিছু উদ্যোক্তো।
এদিকে ভারত থেকে আমদানি করা সুতার মাত্র ১৮ শতাংশ স্থলপথে আসে বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে। স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্তে দেশের পোশাক খাতে তেমন কোন প্রভাব পড়বে না বলে মনে করে সরকার। একইরকম মত পোশাক খাতের বেশকিছু উদ্যোক্তাদেরও। আর স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্তের কারণে সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে দেশে সুতা প্রস্তুতকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছিল।
জানতে চাইলে দেশের নিটওয়্যার পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটি একটি (স্থলপথে ভারত থেকে সুতা আমদানি বন্ধ) ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন স্বল্প লিড টাইমের অর্ডার নেওয়া যাবে না। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বিপদে পড়বেন। যে অভিযোগ এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, একপক্ষের অভিযোগ শুনে সুতা আমদানি বন্ধ করা হয়েছে। এটি উচিত হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘সরকারের এই সিদ্ধান্ত একপেশে। সুতা আমদানির নামে যদি অনিয়ম হয়ে থাকে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারতো। কিন্তু স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধ ঠিক হয়নি।’
জানতে চাইলে ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড এর অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছোট ও মাঝারি পোশাক কারখানার উদ্যোক্তারা ভারত থেকে সড়ক পথে সুতা আমদানি করে থাকেন। কারণ, তারা সমুদ্রপথে জাহাজে বড় লট করে আনতে পারেন না। তাদের সেই সামর্থ্য ও চাহিদা নেই। আবার দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করে সমুদ্রপথে সুতার আনার সক্ষমতাও তাদের নেই। আর সড়ক পথে সুতা আনতে লিড টাইম (সময়) কম। সড়ক পথে আনলে অনেক দ্রুত আনা যায়। সর্বনিম্ন সময়ের মধ্যে টাকাটা বিনিয়োগ করে সুতাটা আনা যায়।’
তিনি বলেন, ‘কোনো ক্রেতার যখন সুতার দ্রুত চাহিদা থাকতো তখন ভারত থেকে সড়ক পথে সুতা আমদানি করতে পারতেন। এখন স্থানীয় বাজার থেকে কিনতে টাকাও বেশি লাগবে। স্থানীয় স্পিনিং মিলগুলোর ব্যবসা ভালো হবে, তবে ছোট ছোট গার্মেন্টস কারখানা যাদের আছে, তাদের ব্যবসায় প্রভাব পড়বে।’
তবে ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধ হওয়ায় খুব বড় আকারের কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন সুরমা গার্মেন্টস এর সত্ত্বাধিকারী ও বিজিএমইএর সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি ফয়সাল সামাদ। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সুতার জন্যে বাংলাদেশ ভারতের ওপর নির্ভরশীল নয়। কিছু গার্মেন্টস আছে যারা সুতার জন্যে ভারতের ওপর নির্ভরশীল। কারণ, তাদের সুতার দাম একটু কম। স্থলপথে সুদা আমদানি আগেও বন্ধ করা হয়েছিল। আমি এটার তেমন কোন প্রভাব দেখি না। যে ফ্যাক্টরিগুলো ভারতীয় সুতার ওপর নির্ভরশীল, তারা হয়তো অন্য পথে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে।’
এক প্রশ্নের উত্তরে ফয়সাল সামাদ বলেন, ‘ছোট উদ্যোক্তারা স্থানীয় বাজার থেকে সুতা নেয়। বড় বড় উদ্যোক্তারা ভারত থেকে নেয়। তারা প্রণোদনার হিসাব বিবেচনা করে না। কারণ ভারত থেকে কম মূল্যে আনা যায়, আর প্রণোদনা পেতে অন্তত তিন বছর লাগে। ফলে সামগ্রিকভাবে ব্যবসার দিক থেকে আমি এটার তেমন কোনো প্রভাব দেখছি না। ভারত থেকে না নিলেও চলবে, কারণ সুতা তো বাংলাদেশে আছেই।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর এক সদস্য জানান, ভারত থেকে ৫ লাখ টনের মতো সুতা আসে। এর মধ্যে মাত্র ১৮ শতাংশ সুতা আসে স্থলপথে। ফলে দেশের পোশাক খাতে খুব একটা প্রভাব পড়বে না। কারণ, এর আগেও ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধ ছিল।
এদিকে স্থলপথে সুতা অমদানি বন্ধ করার সিদ্ধান্তে সরকারকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে দেশে সুতা প্রস্তুতকারক, বস্ত্রকল ও নির্মাতাদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। এক বার্তায় সংগঠনটি বলছে, বিটিএমএ মনে সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে সুতা আমদানি হলে তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হাতে থাকবে। এর মাধ্যমে দেশের টেক্সটাইল সেক্টরের বিদ্যমান অনেক সমস্যার মধ্যে একটির সমাধান হলো। এতে দেশের টেক্সটাইল সেক্টর বিশেষত ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিগুলো শক্তিশালী হবে এবং মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে ও ভ্যালু অ্যাডিশন বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়াও, হুন্ডির মাধ্যমে দেশের অর্থপাচার বন্ধ হবে এবং সরকারের রাজস্ব আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে।
উল্লেখ্য, ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের নেতৃত্বে একই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া করেছিল। ফলে দেশের প্রাইমারি টেক্সটাইল শিল্পের অভুতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়।
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) এক প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ফলে বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা, বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানির সুবিধা বাতিল হয়েছে।
গেল ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানির বন্ধের দাবি জানিয়েছিল বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। দেশে তৈরি সুতার ব্যবহার বাড়াতে স্থলবন্দর দিয়ে পোশাকশিল্পের সুতা আমদানি বন্ধ করার জন্য এনবিআরকে ব্যবস্থা নিতে গেল মার্চ মাসে এক চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। এরই ধারাবাহিকতায় এনবিআর স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধের ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তবে স্থলপথ ছাড়া সমুদ্রপথে বা অন্য কোনো পথে সুতা আমদানি করা যাবে। তথ্যমতে, ভারতের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলে উৎপাদিত সুতা কলকাতায় গুদামজাত করা হয়। এর পর সেখান থেকে সুতা বাংলাদেশে পাঠানো হয়। এসব সুতা তুলনামূলক কম দামে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এ কারণে দেশি সুতার পরিবর্তে স্থলবন্দর দিয়ে আসা সুতা বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। এ কারণে দেশের বস্ত্রশিল্পকারখানাগুলো বড়ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছে বলে দাবি করেছিল বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ)।
জানা গেছে, চীন, তুরস্ক, উজবেকিস্তান এবং দেশে উৎপাদিত সুতার দাম প্রায় একইরকম হলেও স্থলবন্দর দিয়ে আসা ভারতীয় সুতার দাম অনেক কম। অর্থাৎ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি করা সুতা চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে ঘোষিত দামের চেয়ে অনেক কম দামে আসে। তাই বাজারেও কমদামে এই সুতা পাওয়া যায়।
সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম