সন্তানদের কাছে পেতে আদালতে মা, কাঁদলেন বিচারপতি-আইনজীবীরাও
২৫ জুন ২০১৮ ২০:৪৮
।। আব্দুল জাব্বার খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: মা কামরুন নাহার মল্লিকা রাজশাহীর মেয়ে, বাবা মেহেদী হাসান মাগুরার ছেলে। ঢাকার গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের ছাত্রী মল্লিকার সঙ্গে একটি সূত্র ধরে পরিচয় হয় ঢাকা কলেজের ছাত্র মেহেদীর। পরিচয় থেকে দুইজনের প্রেম। এরপর দুইপক্ষের সম্মতিতে ২০০২ সালের ৯ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিয়ে। লেখাপড়া শেষ করে মেহেদী হাসানের চাকুরি হয় একটি প্রাইভেট ব্যাংকে। আর মল্লিকা চাকরি করেন ধানমন্ডির একটি স্কুলে। বিয়ের পর সুখেই কেটে যায় অনেকটা বছর। এর মধ্যে তাদের ঘরকে আলোকিত করে আসে দুটি ফুটফুটে সন্তান। সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে স্কুলেও ভর্তি করে দেওয়া হয়।
সুখের দাম্পত্য জীবনে বাজে বিচ্ছেদের সুর। পাচঁবছর ধরে দুজনের মনোমালিন্যের একপর্যায়ে সংসার ভাঙে তাদের। ২০১৭ সালের ১২ মে হঠাৎ স্বামী মেহেদী হাসান সন্তানদেরকে মাগুরার গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে স্ত্রী কামরুন নাহার মল্লিকের হাতে তালাকনামা ধরিয়ে দেন। বাড়ি থেকে বের করে দেন স্ত্রী কামরুন নাহারকে।
এ অবস্থায় কেটে যায় একটি বছর। এর মধ্যে বাবা মেহেদী হাসান ছেলে সালিম সাদমান দ্রুব (১২), ও সাদিক সাদমান লুব্ধক (৯) কে তাদের ফুফুর কাছে রেখে গ্রামের একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। বাবা ঢাকার উত্তরায় থাকলেও শিশু দুটির সুখের জন্য তার ব্যক্তিগত গাড়িটিও সন্তানদের ব্যবহারের জন্য দিয়ে দেন। সেখাইনে বড় হচ্ছিল শিশু দুটি। এদিকে মা বারবার চেষ্টা করেও সন্তানের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। মা কামরুন নাহার মল্লিকার অভিযোগ সবরকম চেষ্টা করেও সন্তানের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত সন্তানদের নিজের হেফাজতে নেওয়ার জন্য হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন এই মা।
আদালত শুনানি নিয়ে গত ২৯ মে শিশু দুটিকে হাইকোর্টের হাজির করতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও শিশু দুটির বাবাকে নির্দেশ দেন। ২৫ জুন তাদের হাজির করতে বলা হয়। একই সঙ্গে সন্তানকে কেন মায়ের হেফাজতে দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন।
সেই নির্দেশ অনুসারে শিশুদুটিকে আজ আদালতে হাজির করে পুলিশ। এছাড়া শিশু দুটির বাবা-মা, মামা, নানি ও ফুফুসহ আত্মীয় স্বজনেরা আদালতে হাজির হন।
আজ সকালে এ বিষয়ে শুনানি শুরু হয় বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চে। দুইপক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য শোনার পর আদালত এক পর্যায়ে শিশু দুটির বক্তব্য শুনতে চায়।
এ সময় বড় ছেলে সালিম সাদমান দ্রুত আদালতকে বলেন, ‘আমরা বাবা ও মাকে এক সঙ্গে দেখতে চাই। আমরা দুজনকেই চাই। আমরা আর কিছু চাই না।’
দুই শিশুর বক্তব্য শুনে আদালত ফের আইনজীবীদের বক্তব্য শুনেন। এ সময় মায়ের পক্ষের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল আদালতকে বলেন, ‘আজকে একটা বছর ধরে মা তার সন্তানকে দেখতে পাচ্ছে না। আজকে যখন কোর্টে হাজির করা হয়েছে তখনও শিশুর ফুফু কথা বলতে বাধা দিয়েছে।’
এ সময় তিনি সন্তানদের সঙ্গে মায়ের কথা বলার সুযোগ চান। পরে আদালতের অনুমতি পেয়ে মা ছেলেদের কাছে এগিয়ে যেতেই দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু হয়। এ সময় ছেলেরাও দীর্ঘদিন পর মাকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে। বড় ছেলে সালিম সাদমান তখন হাত বাড়িয়ে বাবাকেও ডাকতে থাকে। দুইশিশু তখন বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে-‘বাবা তুমি এসো। তুমি আমাদের কাছে এসো। আম্মুকে সরি বলো। আম্মু তুমিও বাবাকে সরি বলো।
এ সময় বাবাও এগিয়ে এলে আদালতের ভেতর এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। বাবা-মা এবং তাদের সন্তানদের একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নার দৃশ্য দেখে আদালতে উপস্থিত বিচারপতি, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ সকলের চোখে পানি চলে আসে।
এ সময় আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি জেবিএম হাসান আবারও শিশু দুটিকে কাছে ডেকে নেন। সঙ্গে মাকেও কাছে ডাকেন। আদালত বলেন, ‘এ দৃশ্য দেখেও কি আপনাদের মন গলে না। আপনারা কি সন্তানের জন্য নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করতে পারবেন না। সন্তানের স্বার্থের থেকে আপনাদের ইগো বেশি হয়ে গেল। সামনের তাকিয়ে দেখুন আপনাদের এ দৃশ্য দেখে সকলের চোখ দিয়েই পানি পড়ছে।’
এ সময় আদালতের উভয়পক্ষের আইনজীবীসহ শতাধিক আইনজীবী দাঁড়িয়ে সমস্বরে সন্তানদের বিষয়টি চিন্তা করে বাবা-মাকে মেনে নেওয়ার দাবি জানান। একই সঙ্গে সন্তানদের চাওয়া অনুযায়ী তাদের দাম্পত্য জীবন যাতে বজায় থাকে এ সে রকম একটি আদেশ দেওয়ার দাবি জানান।
এ সময় আদালতে উপস্থিত সকলের চোখ মুছতে দেখা যায়।
পরে আদালত দুটি সন্তান, বাবা-মা এবং শিশু দুটির নানী ও ফুফুকে আদালতের এজলাসের কাছে ডেকে নেন। এ সময় একে একে প্রত্যেকের বক্তব্য শুনেন। পরে আরও বিস্তারিত শুনতে বিচারপতিদের খাস কামরায় ডেকে নিয়ে বাবা ও মায়ের একান্ত বক্তব্য শোনেন।
পরে তাদের বক্তব্য শুনে আদালত মধ্যাহ্ন বিরতিপর পর আদেশ দেন।
আদালত আদেশে বলেন, আগামী ৪ জুলাই পর্যন্ত শিশু সন্তান দুটি মায়ের হেফাজতে থাকবে। তবে এই সময়ে বাবা শিশু দুটির দেখাশোনা করার অবারিত সুযোগ পাবেন। আগামী ৪ জুলাই পরবর্তী দিন ঠিক করে শিশুদুটিকে হাজির করার নির্দেশ দিয়ে বিষয়টি মুলতবি করেন।
আদালতে শিশু দুটির বাবার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তাপস বল। মায়ের পক্ষে ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। সঙ্গে ছিলেন এ কে এম রিয়াদ সলিমুল্লাহ।
পরে আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। দুটি বাচ্চার এমন কান্নার দৃশ্য দেখে আজকে আদালতে উপস্থিত সবাই চোখের পানি ফেলেছে। আজকে এমন একটি পরিবেশ আদালতের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে যা আমাদের সবাইকে আপ্লুত করেছে। বাচ্চা দুটি আজ আদালতে উচ্চস্বরে বলতে ছিল আমরা বাবা এবং মাকে একসঙ্গে দেখতে চাই। আমার ধারণা বাচ্চাদের সেই আকুতি হয়ত বাবা-মায়ের মধ্যে দাগ কেটেছে। আমরা আশা করব বাবা-মা তাদের দাম্পত্য কলহ ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করবে।’
আদেশের পরে সন্তানের মা কামরুন নাহার মল্লিকা সাংবাদিকদের বলেন, আমি আমার সন্তানকে পেয়েছি। আমি খুশি। এর থেকে বেশি কিছু বলার ভাষা নেই।
বাবা মেহেদী হাসান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার সন্তানেরা সন্তুষ্ট। এরপর আমার আর বলার কিছু নেই।’
সারাবাংলা/এজেডকে/একে