Monday 21 Apr 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্বামীর লাশের দাবিদার সাবেক ও বর্তমান স্ত্রী, ১১ বছর পড়ে আছে হিমঘরে!

সোহেল রানা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২০ এপ্রিল ২০২৫ ১০:০০ | আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৫ ০৫:০৬

ঢাকা মেডিকেল কলেজের মরচুয়ারি। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: এক মরদেহের দাবিদার দুই স্ত্রী। দুই জনের মধ্যে প্রথম স্ত্রীর দাবি, তার স্বামী ছিলেন সনাতন ধর্মের অনুসারী। সে অনুযায়ী তার মরদেহ সৎকার করা হবে এবং তার সম্পদের উত্তরাধিকারীও তিনি। দ্বিতীয় স্ত্রী বলছেন, খোকন এফিডেভিটের মাধ্যমে সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। তার মরদেহ দাফন করা হবে মুসলিম রীতি অনুযায়ী। এ নিয়ে আদালতের রায়ের অপেক্ষায় আছেন দুই স্ত্রী।

জানা গেছে, ২০১৪সালের ১৫ জুন দ্বিতীয় স্ত্রী হাবিবা আক্তার ওরফে বাবলির বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়েন খোকন চৌধুরী (৬৮)। পরে তাকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৬ জুন মারা যান তিনি। এর পর হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে স্বামীর মরদেহ দাফনের উদ্যোগ নেন হাবিবা আক্তার। এতে বাধা দেন খোকনের প্রথম স্ত্রী মীরা নন্দী। সনাতন রীতি অনুযায়ী সৎকারের জন্য মরদেহ নিয়ে যেতে চান তারা। এই প্রেক্ষাপটে ঘটনাস্থলে যায় রমনা থানা পুলিশ। পরে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়।

বিজ্ঞাপন

প্রথমে তার মরেদহ বারডেমের হিমঘরে রাখা হয়। সেখানে দীর্ঘ মেয়াদে মরদেহ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় বারডেম কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আদালতকে জানায়। ওই বছরের ২৩ অক্টোবর সহকারী জজ আদালতের আদেশে বারডেম জেনারেল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় ও তদারকিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) মর্চুয়ারিতে মরদেহটি সংরক্ষণের আদেশ দেন। ২০২৫ সালের ১৫ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ মরদেহটি গ্রহণ করে।

১১ বছর ধরে ঢামেকের মর্চুয়ারিতেই পড়ে আছে খোকন, ওরফে খোকন নন্দী, ওরফে খোকন চৌধুরী, ওরফে খোকা চৌধুরী, ওরফে রাজীব চৌধুরীর মরদেহ। এই মরদেহ আর কত দিন মর্চুয়ারিতে থাকবে সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারছে না। আইনি জটিলতায় মরদেহটি মর্গের হিমঘরে পড়ে আছে। এর আগে এতদিন কোনো মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেনি মর্গের কেউ।

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. গোলাম মোখলেসুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘খোকন, ওরফে খোকন নন্দী, ওরফে খোকন চৌধুরী নামে একটি মরদেহ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গের হিমঘরে পড়ে রয়েছে। জানতে পেরেছি দুই ধর্মের দুই স্ত্রী স্বামীর মরদেহের দাবিদার। এ নিয়ে আদালত এখনো সিদ্ধান্ত দেননি। আদালতের নির্দেশ পেলে আমরা মরদেহ হস্তান্তর করতে পারব।’

সদ্য অবসরে যাওয়া ঢামেক মর্গের ইনচার্জ সেকেন্দার আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি বহু বছর ধরে এই মর্গে কাজ করেছি। পরে ইনচার্জের দায়িত্বে ছিলাম। আমার দেখামতে এত দীর্ঘ সময় কোনো মরদেহ পড়ে থাকতে দেখি নাই। যদিও এই মরদেহ নিয়ে আইনি জটিলতা রয়েছে। আদালতের নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত মরদেহ মর্গেই থাকবে।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের বর্তমান ইনচার্জ রামু চন্দ্র দাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনেকদিন ধরেই মর্গে কাজ করছি, অনেক বিদেশির মরদেহ মর্চুয়ারিতে থাকে। কিন্তু এই মরদেহের মত এত দীর্ঘ সময় কোনো মরদেহ রাখা হয়নি। আগে যখন অনেক অজ্ঞাতসহ বিদেশিদের মরদেহ থাকতো, তখন ফ্রিজ নষ্টের কারণে বিপাকে পড়তে হতো। এখন একটি বড় ফ্রিজ থাকাতে কোনো সমস্যা হয় না। তবে আমি চাই খোকন নামে ওই মরদেহের দাবিদারের বিষয়টি আদালতের মাধ্যমে দ্রুত সুরাহা হোক।’

এ বিষয়ে গত ১৬ এপ্রিল দুপুরে খোকন নন্দী ওরফে খোকন চৌধুরীর দ্বিতীয় স্ত্রী হাবিবা আক্তার খানমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী খোকনের মরদেহ ১১ বছর ধরে ঢামেক মর্গে ফ্রিজে পড়ে আছে। আদালত এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন না যে, লাশ কে পাবে? মামলাটি বর্তমানে হাইকোর্টে আছে। আগের স্ত্রী আদালতের কাছে তিন মাসের সময় চেয়েছে। যেটা এ মাসেই শেষ হবে। আগামী ২০এপ্রিলের পর আমাদের একটি ডেট আছে। সেই অপেক্ষাতেই আছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘মরদেহটি এতদিন মর্গের হিমঘরে পড়ে আছে। সেটি শুকিয়ে যাচ্ছে। আমি এর সুরাহা চাই। ওকে আর কষ্ট দেবেন না। মরদেহটি তো আর সম্পত্তি নয়। এ বিষয়ে আমি মানসিক অশান্তিতে আছি। মৃত্যুর আগে ওর মরদেহটি দাফন করতে চাই।’

হাবিবা বলেন, ‘বড় স্ত্রী আদালতের কাছ থেকে বারবার সময় নিয়ে সময় ক্ষেপণ করছেন। কয়েক বছর আগে ঢামেক মর্গে গিয়ে স্বামীর মরদেহ দেখে এসেছি। কিন্তু ওই পক্ষ এখন পর্যন্ত মরদেহ দেখতেও যায়নি। তারা চাইছে, সময় নষ্ট করতে। পরে আমি মারা গেলে সম্পত্তি ভোগ দখল করবে। আমার কোনো সন্তান নেই। ফলে তাদের আর কোনো সমস্যাই হবে না। আমাদের যে ধর্মীয় রীতিতে বিয়ে হয়েছিল, সেসংক্রান্ত নথিসহ বিভিন্ন সাক্ষী আদালতের কাছে হাজির করেছি।’

রাজধানীর কাকরাইল উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে অবসর নেওয়া শিক্ষিকা হাবিবা আক্তার বলেন, ‘খোকন বিভিন্ন সময় বলেছেন, তার একটি মেয়ে আছে। ছেলে আছে কখনো বলেননি। স্বামীর মৃত্যুর পর এখন ছেলেও হাজির হয়েছেন। ফার্মগেটের ক্যাপিটাল সুপার মার্কেটসহ খোকনের অনেক সম্পত্তি ছিল। সে সম্পত্তির পরিমাণ কত, তা জানি না। তবে খোকন মৃত্যুর আগে ফার্মগেটের ক্যাপিটাল সুপার মার্কেট আমার নামে লিখে দেওয়ার জন্য অছিয়ত করে গেছেন। তখন ওই মার্কেটের চতুর্থতলার নির্মাণ কাজ চলছিল।’

তিনি বলেন, ‘মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত খোকন আগের পক্ষের স্ত্রী বা অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তিনি মারা যাওয়ার সময় মীরা নন্দীর এক ভাই তাকে খবর দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। তখন বারডেম হাসপাতালে মরদেহ নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। পরে রমনা থানা থেকে পুলিশ আসে। তারপর তো এত ঘটনা।’

হাবিবা খানম বলেন, ‘বারডেম হাসপাতালে খোকনের মরদেহ হিমঘরে রাখা বাবদ বিল হয়েছিল ২ লাখ ২৬ হাজার টাকা। আদালতের আদেশে যে স্ত্রী স্বামীর মরদেহের পাবেন, তাকেই এ বিল পরিশোধ করতে হবে।’ এ নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করে হাবিবা বলেন, ‘মরদেহ পেলে এত টাকা আমি কোথা থেকে পরিশোধ করব। কেননা খোকন মারা যাওয়ার পর থেকে ক্ষমতার দাপটে তার ভাই, আগের পক্ষের স্ত্রী ও অন্যরাই তার কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ভোগ দখল করছেন।’

মীরা নন্দীর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথম স্ত্রীর কারণেই ওই সংসার ত্যাগ করেন খোকন। এমনকি তার ছেলে বাবলুকে কোনো দিন সন্তান বলে স্বীকার করেননি। তবে ওই ঘরের চন্দনাকে নিজের মেয়ে বলে স্বীকার করতেন।’

হাবিবা খানম মনে করেন, খোকনের মরদেহ মর্গে পড়ে থাকার মূল কারণ ধর্মীয় নয়, বরং সম্পত্তি দখল। তার প্রথম স্ত্রীর লোকজন ও ভাইয়েরা আদালতে শুধু সময় নিয়ে কালক্ষেপণ করছেন। তারা মার্কেটের ভাড়া তোলে, ইচ্ছেমতো অগ্রিম টাকা নিয়ে দোকানপাট ভাড়া দেয়। অথচ তার মরদেহ ১১ বছর ধরে পড়ে আছে। সেটা দাফনের বিষয়ে কারও কোনো উদ্যোগ নেই। ধর্মান্তরিত হলেও ব্যবসার প্রয়োজনে খোকন তার আগের নাম খোকন নন্দীই ব্যবহার করতেন বলে জানান দ্বিতীয় স্ত্রী।

হাবিবা এখন অনেকটাই অসুস্থ। তিনি চান, তার মৃত্যুর আগে স্বামী খোকনের মরদেহ দাফন করতে। এ বিষয়টি দ্রুত সুরাহার জন্য সংশ্লিষ্টদের কাছে অনুরোধও জানান তিনি।

উল্লেখ্য, পল্টনে এক চটপটির দোকানে পরিচয়ের পর ১৯৮৪ সালের ১৫ জুলাই খোকনের সঙ্গে হাবিবার বিয়ে হয়। আর বিয়ের আগে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এফিডেভিট করে খোকন নন্দী ধর্মান্তরিত হন। নাম রাখেন খোকন চৌধুরী। তাদের বিয়ের কাবিননামা ও এফিডেভিট আছে। আদালতে সব নথিপত্র উপস্থাপন করা হয়েছে।

খোকন জীবিত থাকার সময় তার চার ভাইয়ের মধ্যে তিন ভাই হিরালাল নন্দী, শান্তি নন্দী ও সাগর নন্দী উত্তর শাহজাহানপুরের বাসায় যাতায়াত করতেন। শ্বশুরবাড়ির অন্য আত্মীয়রাও আসতেন। স্থানীয় লোকজন খোকন চৌধুরীকে মুসলমান হিসেবেই জানতেন। খোকা ভাই নামে ডাকতেন। শাহজাহানপুরের বাসায় তারা ১৮ বছর ছিলেন। তাদের কোনো সন্তান নেই।

সারাবাংলা/এসএসআর/পিটিএম

২ স্ত্রী দাবিদার মরদেহ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর