ব্রি উদ্ভাবিত উফশি জাতের ধানে ঝুঁকছেন সুবর্ণচরের কৃষক
২৪ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:০০ | আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২৫ ০৩:২১
নোয়াখালী: বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে ব্রি উদ্ভাবিত উফশি জাতের বোরো ধান বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন নোয়াখালীর সুবর্ণচরের কৃষকরা। এ অঞ্চলের ৯৫ শতাংশ কৃষক বোরো মৌসুমে বাজারের হাইব্রিড ধানের ওপর নির্ভর ছিলেন। এখন তারা ব্রি উদ্ভাবিত উফশি জাতে ঝুঁকছেন। এতে পাচ্ছেন প্রত্যাশিত ফসল। কমছে উৎপাদন খরচ। বাড়ছে আয়। নেই তেমন রোগবালাই।
প্রায় দুই যুগ ধরে এ অঞ্চলের কৃষকরা স্থানীয় বীজ থেকে ধান উৎপাদন না করে হাইব্রিড আবাদ করে আসছেন। তাদের বীজ সংরক্ষণের সুযোগ না থাকায় বাজার থেকে ক্রয় করতেন।
সম্প্রতি সময়ে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফ এর কৃষি ইউনিটের অর্থায়নে সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে কৃষকদের বীজ সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। যা বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি সার্বিক সহযোগিতা করে আসছে। এতে স্থানীয় কৃষক সুফল পেয়ে আসছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে সুবর্ণচর উপজেলায় ১৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়। যার মধ্যে ১৫ হাজার ৭০০ হেক্টর হাইব্রিড ধান এবং ৮০০ হেক্টর ব্রি উদ্ভাবিত উফশী জাতের কয়েক ধরনের ধান আবাদ করা হয়েছে।
কৃষকরা জানায়, প্রতি বছর বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানীর হাইব্রিড ও দেশীয় উফশি জাতের কয়েকটি বীজ ক্রয় করে আবাদ করে আসছে তারা। হাইব্রিডের বাহিরে ব্রি উদ্ভাবিত উফশি ২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ ধানই মূলত আবাদ হতো। এর মধ্যে হাইব্রিড বীজের কেজি ক্রয় করছেন ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকায়। আর উফশি প্রতি কেজি ধানের বীজ ৫০-১০০ টাকা। এর মধ্যে প্রতি একর জমিতে হাইব্রিড ধানের বীজ লাগে ৬ কেজি এবং উফশি জাতের বীজ প্রয়োজন হয় ১০ কেজি। এসব বীজের মধ্যে হাইব্রিড প্রতি একরে উৎপাদন হয় ৯০মন, উফশি ব্রি-২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ উৎপাদন হয় ৭০-৭৫ মন।
সরেজমিনে কৃষক ও কৃষিবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত দুই বছর এ অঞ্চলে ব্রি-২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ এর পাশাপাশি ব্রি ধান ৭৪, ৯২, ১০০, ১০১, ১০২, ১০৪, ১০৫, ১০৭ জাতের আবাদ করা হচ্ছে। যা ব্রি ধান ২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ জাতের চেয়ে আরও উন্নত এবং রোগ বালায় সহনশীল।
দেখা যায়, সর্বশেষ উদ্ভাবিত ব্রি ধান৭৪, ৯২, ১০০, ১০১, ১০২, ১০৪, ১০৫, ১০৭ জাতের বীজে ধান উৎপাদন হচ্ছে প্রতি একরে ৮৫-৯০ মন পর্যন্ত। যা বিদেশি হাইব্রিডের থেকে কোনো অংশে কম নয়।
সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা ইউনিয়নের কৃষক ওমর ফারুক জানান, এ বছর সাগরিকার উৎসাহে তিনি ২ একর জমিতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ব্রি ধান৯২ আবাদ করেছেন। দুই একর জমিতে বীজ, সারসহ এপর্যন্ত তার খরচ হয়েছে ৬২ হাজার টাকা। চলতি মৌসুমে অন্তত ১৭০ মন ধান উৎপাদন হবে তার দুই একর জমিতে। যার বাজার মূল্য দেড় লাখ টাকারও বেশি। উৎপাদিত এ ধান থেকে অন্তত পক্ষে ২৫ মন ধানের বীজ সংরক্ষণ করবেন।
কৃষকরা জানান, পিকেএসএফ সাগরিকার মাধ্যমে ইতোমধ্যে তাকে বীজ সংরক্ষণ ও বাজারজাত করণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। একই সঙ্গে বীজ সংরক্ষণের জন্য উপকরণ সহায়তাও দিয়েছেন। ভবিষ্যতে তারা জমিতে উৎপাদিত বীজ দিয়েই জমি আবাদ করবেন এবং বাজারে বীজ বিক্রি করবেন। এতে করে কোম্পানীর বীজের ওপর তার নির্ভরশীলতা থাকবে না।
পূর্ব চরবাটা ইউনিয়নের মোস্তফা নামে আরেক কৃষক জানান, দুই একর জমিতে ব্রি ধান৭৪ জাত আবাদ করেছেন।
তিনি বলেন, হাইব্রিড ধানের মতোই তার জমিতে ফলন হয়েছে। নিজ দেশের উদ্ভাবিত এ জাত আবাদ করে তিনি খুশি। আগামী দিনে নিজেদের বীজ নিজেরা সংরক্ষণ করে এবং তা আবাদ করে ভালো ফলন পাবেন বলে তিনি আশা করছেন।
এ বিষয়ে পিকেএসএফ এর কৃষি ইউনিট পরিচালিত সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কৃষিবিদ শিবব্রত ভৌমিক বলেন, ‘এ অঞ্চলের ৯৫ শতাংশ কৃষক বোরো মৌসুমে মূলত বাজারের হাইব্রিড ধানের ওপর নির্ভর থাকে। দেশি উদ্ভাবিত ব্রি ধান ২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ জাত আবাদ করে মাত্র ৫ শতাংশ কৃষক। আমরা সম্প্রতি দেখেছি বিগত সময়ে আবাদকৃত ধানগুলোতে রোগ-বালায় বেড়ে গেছে। এতে কৃষক দিন দিন লোকসানে পড়ছে। সর্বশেষ নতুন ব্রি উদ্ভাবিত ব্রি ধান৭৪, ৯২, ১০০, ১০১, ১০২, ১০৪, ১০৫, ১০৭ জাতের ফলন হচ্ছে হাইব্রিডের মতো এবং রোগবালাই নাই বললেই চলে। যার ফলে পিকেএসএফ এর অর্থায়নে এবং বীজ প্রত্যায়ণ এজেন্সির সহযোগিতায় সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা কৃষকদের মাঝে দেশীয় এসব জাতগুলো আবাদে উৎসাহ দিয়ে আসছে।’
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) নতুন উদ্ভাবিত বোরো ধানের ব্রি আঞ্চলিক কার্যালয়, সোনাগাজী, ফেনীর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আমিনুল ইসলাম জানান, ব্রি মূলত উচ্চ ফলনশীল আধুনিক ধানের জাত ও উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে প্রতিনিয়ত গবেষণা করে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় বোরো মৌসুমের সর্বশেষ জাত ব্রি ধান৭৪, ৮১, ৮৪, ৮৮, ৮৯, ৯২, ৯৬, ৯৭, ৯৯, ১০০, ১০১, ১০২, ১০৪, ১০৫, ১০৭ ও ১০৮ উদ্ভাবন করা হয়। এসব জাতে ফলন হচ্ছে হাইব্রিডের মতো এবং কখনো কখনো হাইব্রিড ধানের চেয়েও বেশি। একই সঙ্গে নতুন উদ্ভাবিত এসব জাতের মধ্যে ব্রি ধান৭৪, ৮৪, ১০০ ও ১০২ জিঙ্ক ও উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ। ব্রি ধান ৮৪ তে জিঙ্কের পাশাপাশি আয়রণও আছে। ব্রি ধান১০১ পাতাপোড়া রোগ প্রতিরোধী, ব্রি ধান১০৪ সুগন্ধি ও বাসমতি টাইপ, ব্রি ধান১০৫ লো-জিআই (ডায়াবেটিক রোগীদের খাওয়ার উপযোগী)। এসমস্ত জাতসমূহ সম্প্রসারণ করা গেলে কৃষকরা যেমন লাভবান হবে, ভোক্তাও প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাবে বলেও তিনি জানান।
সারাবাংলা/এসআর
উফশি জাতের ধান ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট নোয়াখালী সুবর্ণচরের কৃষক