Wednesday 23 Apr 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ট্রাম্পের পালটা শুল্ক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় অস্থির সোনার বাজার

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২২ এপ্রিল ২০২৫ ১০:২০

বিশ্ব বাজারে সোনার দাম আউন্সপ্রতি সাড়ে ৩ হাজার ডলার ছুঁইছুঁই। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: বিশ্ব বাজারে সোনার দাম লাফিয়ে বাড়ছে। সেইসঙ্গে বাংলাদেশেও পাল্লা দিয়ে আকাশ ছোঁয়া হয়ে উঠছে এই মূল্যবান ধাতু। বিশ্ব বাজারে এখন সোনার দাম আউন্সপ্রতি সাড়ে ৩ হাজার ডলার ছুঁইছুঁই। রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশে এখন সোনার ভরি ১ লাখ ৭২ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। গত এক মাসে দেশে সোনার দাম পরিবর্তন হয়েছে অন্তত ১০ বার। এর মধ্যে নয় বার-ই দাম বেড়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশ্বে অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণেই সোনার দাম লাফিয়ে বাড়ছে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণেই বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সবাই এখন সোনায় বিনিয়োগ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পালটা শুল্কনীতির কারণও সোনার বাজারে প্রভাব রাখছে। দেশে দেশে বাণিজ্য যুদ্ধ ও টালমাটাল অর্থনীতিতে ডলারের বাজারে অবনমন ঘটছে। এছাড়া, অস্থির সময় পার করছে পুঁজিবাজার। আর এসব কারণেই বিশ্বে সোনার চাহিদা বাড়ছে। তাই বেড়ে চলছে দামও।

বিজ্ঞাপন

রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশে এখন সোনার ভরি ১ লাখ ৭২ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সোমবার (২১ এপ্রিল) জুয়েলারি ব্যবাসীয়দের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) সোনার নতুন দাম নির্ধারণ করেছে। বাজুসের নতুন ঘোষণা অনুযায়ী, ২২ এপ্রিল থেকে ভালো মানের ২২ ক্যারেটের প্রতিভরি (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) সোনা কিনতে লাগবে ১ লাখ ৭২ হাজার ৫৪৬ টাকা। এ ছাড়া, ২১ ক্যারেটের সোনার দাম ভরিপ্রতি নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৬৫৩ টাকা। ১৮ ক্যারেটের প্রতিভরি পড়বে ১ লাখ ৪১ হাজার ১৩৩ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির প্রতিভরির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৫০ টাকা।

বিজ্ঞাপন

বাজুসের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, স্থানীয় বাজারে তেজাবি সোনার (পিওর গোল্ড) দাম বেড়েছে। তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাজুসের মূল্য নির্ধারণ ও মূল্য পর্যবেক্ষণ স্থায়ী কমিটির সভায় সোনার নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। তথ্যমতে, সর্বশেষ এক মাসে সোনার দর সংশোধন হয়েছে ১০ বার। এর মধ্যে একবার সোনার দাম কমেছে, বেড়েছে নয় বার।

এদিকে, বিশ্ববাজারে সোমবার (২১ এপ্রিল) সোনার দাম আউন্সপ্রতি ৩ হাজার ৪২৪ ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। সোনার দাম পর্যবেক্ষকারী ওয়েবসাইট গোল্ড প্রাইস’র তথ্যমতে, ২১ এপ্রিল বিশ্ব বাজারে সোনার দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর গত ১ মাসে বেড়েছে ১০ দশমিক ১৭ শতাংশ। গত ৬ মাসে সবমিলিয়ে সোনার দাম বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি। আর বছর ব্যবধানে বিশ্ব বাজারে সোনার দাম বেড়েছে ৪২ শতাংশ। সেইসঙ্গে ৫ বছরে বিশ্ব বাজারে সোনার দাম বেড়েছে ৯৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

জানতে চাইলে বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিং কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে সোনার দাম নির্ধারণ করতে হয়। সোনার দাম সমন্বয় না করলে একদেশে কম, আরেক দেশে বেশি, তখন সোনার দামে বৈষম্য থাকবে, আর এই বৈষম্যের কারণে এক দেশের সোনা আরেক দেশে চোরাচালানের মাধ্যমে পাচার হয়ে যাবে। এ কারণে আমরা দাম সমন্বয় করতে বাধ্য। আমাদের দেশে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে সোনার দাম ওঠানামা করে। যদি এটি অনলাইন বেইজড হতো, ওই স্ট্রাকচারেই এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে দাম উঠতো এবং নামতো। তখন হিসাব রাখা মুশকিল হয়ে যেত।’

তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে বাজুস সোনার দাম নির্ধারণ করতে পারে না। বাজুস সোনার দাম নির্ধারণ করে তাঁতীবাজারে যে বুলিয়ান মার্কেট আছে, ওই বুলিয়ান মার্কেটে যে রেট ওঠানামা করে তার ওপর নির্ভর করে। তবে তাঁতীবাজারের বুলিয়ান ব্যবসায়ীরা কীভাবে অন্তর্জাতিক বাজারকে ফলো করে সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই। যতবার রেট বাড়বে বা কমবে ততবার আমাদের সমন্বয় করতে হবে, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, এটি সারাজীবন ফলো করে যেতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘২০০৯ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজার ফলো করে সোনার দাম নির্ধারণ করতো বাজুস। কিন্তু এর পরে পরিবর্তন আসে। ওই পরিবর্তনের ধারায় এখন আমাদের চলতে হচ্ছে। আমরা লোকাল সোর্স থেকে কোন গোল্ড পাই না। বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো গোল্ডের রেট দেয় না। আমদানিকারক যারা আছে তারাও আমদানি করে না। বাংলাদেশে কোনো রিফাইনারি নেই। তাঁতীবাজারে যারা সলিড গোল্ডের ব্যবসা করে, বুলিয়ান মার্কেট যেটি আছে, সেই বুলিয়ান মার্কেট আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে তারা রেটটা দেয়। আমরা সেই রেটটিকে ফলো করি। এটাকেই আমরা বলতে পারি আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয়।’

জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্ব অর্থনীতির অনিশ্চয়তার কারণে সোনার দাম বাড়ছে। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর পালটা শুল্কারোপ করেছে। অর্থনীতিতে এক ধরনের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এখন সিদ্ধান্তের কোনো নিশ্চয়তা নেই। ডলারের দরপতন ঘটছে। বিশ্বের পুঁজিবাজারও অস্থিতিশীল। বন্ড মার্কেটের অবনমন ঘটছে। ট্রাম্প কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে। সবমিলিয়ে ডলারের ওপর সবার আস্থা কমে গেছে। ফলে মানুষ এখন সোনার দিকে ঝুঁকছে। আর কারণেই বিশ্ব বাজারে সোনার দাম বাড়ছে।’

এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন করে কিন্তু সোনা কেনেনি। আগে কেনা সোনার ওপর ভিত্তি করে রিজার্ভ বেড়েছে। আবার বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে মানুষ এখন ডলারকে নিরাপদ না মনে করে সোনা, বিট কয়েন ও সুইডেনের মুদ্রা ক্রোনার ওপর আস্থা রাখছে। এসব কারণেই সোনার দাম বেড়ে চলছে। সোনায় বিনিয়োগকে মানুষ এখন নিরাপদ মনে করছে।’

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতি বিশ্লেষক মো. মাজেদুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্বের অর্থনীতি যখন আনসার্টেন অবস্থায় চলে যায় তখন সোনার দাম বাড়ে। পৃথিবীর সমস্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক সোনা মজুদ করতে থাকে। সোনা মজুদের এক পর্যায়ে তা বিক্রি করে রিজার্ভ বাড়ায়। ওয়াশিংটন চুক্তি ১৯৯২ অনুযায়ী পৃথিবীর কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক বছরে ৪ হাজার কেজির বেশি সোনা বিক্রি করতে পারবে না। বিশ্বের অর্থনীতি যখন অস্থিতিশীল থাকে তখন সোনার দাম বাড়ে। কারণ তখন সবাই সোনা মজুদ রাখতে চায়। তখন সবাইকে সোনাকে ইনভেস্টমেন্ট (বিনিয়োগ) হিসাবে রাখতে চায়। এজন্য তখন সোনার চাহিদা বেড়ে যায়, এবং দাম বাড়ে। পৃথিবীর সমস্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তখন সোনাগুলো কিনে রাখতে চায়। পরবর্তী সময়ে সেগুলো বিক্রি করে রিজার্ভের সঙ্গে সংযুক্ত করতে চায়। চাহিদা ও বিশ্ব অর্থনীতিতে যখন অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, তখনই সোনার দাম বাড়ে।’

তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প যে পালটা শুল্কারোপ করছে তার প্রভাব সোনার বাজারে এমনিতেই রয়েছে। পালটা শুল্কারোপের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি বাণিজ্য যুদ্ধ চলছে, অর্থনীতিতে নৈরাজ্য চলছে। অর্থনীতিতে যে যুদ্ধ চলছে, সেটি কবে থামবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। ট্রাম্পের পালটা কারণেও সোনার দাম ওঠানামার পেছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। কোনো অর্থনীতিতে যখন মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে তখনও কিন্তু সোনার দাম বাড়ে। বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণেই সোনার দামে এত উত্থান।’

প্রসঙ্গত, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পালটা শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আর এই যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন। এ কারণে সোনার দাম নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা এ বছরের সোনার দামের এই বৃদ্ধিকে চার দশকেরও বেশি আগেকার ইরানি বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ১৯৭৯ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৮০ সালের জানুয়ারির মধ্যে সোনার দাম প্রায় ১২০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। গত মাসে প্রথমবারের মতো সোনার দাম আউন্সপ্রতি ৩ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাবে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় এমনটা ঘটছে বলে মনে করেন তারা।

এদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পালটা শুল্কের জেরে বিশ্ববাজারে যেভাবে সোনার দাম বাড়ছে, তাতে চলতি বছরের শেষ নাগাদ সোনার দাম আউন্সপ্রতি ৩ হাজার ৭০০ ডলারে গিয়ে ঠেকতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান মার্কস। এর আগের তাদের পূর্বাভাস ছিল আউন্সপ্রতি ৩ হাজার ৩০০ ডলার। শুধু তা–ই নয়, তারা বলছে, সোনার দাম আউন্সপ্রতি ৩ হাজার ৬৫০ ডলার থেকে ৩ হাজার ৯৫০ ডলারের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে পারে। মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদা ও সোনাভিত্তিক ইটিএফ তহবিলে বিনিয়োগ বাড়বে— এই অনুমানের ভিত্তিতে এই পূর্বাভাস দিয়েছে গোল্ডম্যান স্যাক্স। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বরাতে এ তথ্য জানা গেছে।

সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম

অর্থনৈতিক অস্থিরতা ট্রাম্প বেড়েছে বৈশ্বিক সোনার দাম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর