রংপুরে সরকারি ধান সংগ্রহে এবারও ব্যর্থ খাদ্য বিভাগ
২৩ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:০০ | আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:১০
রংপুর: কৃষি অঞ্চল খ্যাত রংপুরে বরাবরের মতো এবারও ধান সংগ্রহে ব্যর্থ হয়েছে খাদ্য বিভাগ। চালের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলেও ধানের অর্জন মাত্র ১২ শতাংশ। কৃষকদের অভিযোগ, খাদ্য কর্মকর্তা ও মিল মালিকদের যোগসাজশে ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা। খাদ্য বিভাগ অবশ্য ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে বলছে, বাজারের দামের পার্থক্য থাকায় ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরুণ হয়নি। অন্যদিকে বিভাগের আট জেলায় চাল সরবরাহের চুক্তি না করায় ৭৮৭ মিলারের লাইসেন্স বাতিল হয়েছে।
রংপুর আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৭ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমন ধান ও চাল সংগ্রহের অভিযান চলে। আমন মৌসুমে রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় আমন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭৫ হাজার ৯৪০ মেট্রিক টন। সেখানে অর্জন হয়েছে মাত্র ১২ শতাংশ। অন্যদিকে আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছিল ১৮ হাজার ১৬৪ মেট্রিক টন। আর সিদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ৩৪ হাজার ৭৫৪ মেট্রিক টন। এই দুই ধরনের চাল সংগ্রহে সফলতা শতভাগ।
জানা গেছে, এই চাল তিন হাজার ২৩৬ জন মিলারের দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ৭৮৭ জন মিলার চাল সরবরাহে খাদ্য বিভাগের সঙ্গে চুক্তি করেনি। ফলে তাদের লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে খাদ্য বিভাগ। বাতিলের সিদ্ধান্ত হওয়া মিলারদের মধ্যে- ১০৪টি রংপুরের, লালমনিরহাটে ২৬টি, নীলফামারীর ২৪, কুড়িগ্রামে ৩৪, দিনাজপুরে ২৯৬, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৩৯ এবং পঞ্চগড়ে ৩৩টি আটো ও হাস্কিং মিল রয়েছে।
রংপুর আঞ্চলিক খাদ্যনিয়ন্ত্রক জহিরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় ৭৮৭ মিলার চাল সরবরাহের সামর্থ্য থাকার পরেও চুক্তি করেনি। এর মধ্যে ৩৫৯ মিলারের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। বাকিদের লাইসেন্স বাতিলের প্রক্রিয়া চলমান।’ ধান সংগ্রহ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাজারের দামের পার্থক্য থাকায় ধানের লক্ষ্যমাত্রা পূরুণ হয়নি।’
এদিকে প্রতিবছরই ধান সংগ্রহে খাদ্য বিভাগ ব্যর্থ হওয়ায় রংপুর বিভাগের ৮ জেলা ও উপজেলার খাদ্যগুদামে ধানের মজুত আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। কৃষকদের অভিযোগ– খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা ও মিল মালিকদের যোগসাজশে প্রতিবছর কৃষক গুদামে ধান দিতে পারে না। এদিকে সরকারি গুদামে ধান কেনা শুরু হয় অনেক পরে। আর সেখানে ধান বিক্রি করতে গেলে অনেক সময় ফিরিয়ে দেওয়া হয়। নানা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়।
খাদ্য বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, যেসব মিলের কার্যক্রম একেবারেই বন্ধ, তাদের অনেকের সঙ্গে চাল সরবরাহের চুক্তি করেছেন খাদ্য বিভাগের উপজেলা ও জেলা কর্মকর্তারা। তাদের মধ্যে প্রায় ৬০ ভাগ মিল মালিকের কোনো চাতাল ও মিল চালু নেই। তারাও চাল সরবরাহ করেছেন সরকারি খাদ্যগুদামে।
জানা যায়, সরকারিভাবে যেসব চাল বিভিন্ন প্রকল্পের নামে কম দামে সরবরাহ করা হয়, সেগুলো প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে গোপনে মিল মালিকরা এজেন্টের মাধ্যমে কিনে থাকেন। পরে তা বিভিন্ন অটোরাইস মিলে বিশেষ পদ্ধতিতে ছাঁটাই করে নতুন চাল হিসেবে সরকারি খাদ্যগুদামে সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
রংপুরের চতরা ইউনিয়নের কৃষক রাজু মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকারি খাদ্যগুদামের বিড়ম্বনা এড়াতে ব্যবসায়ীর কাছে ধান বিক্রি করেছি।’ তিনি জানান, প্রতি বিঘায় ধান পেয়েছেন গড়ে ১৬ থেকে ১৮ মণ। আর বিঘাপ্রতি খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকা করে। প্রতিমণ ধান বিক্রি করেছেন ১ হাজার ৪৪০ টাকা। সে হিসাবে প্রতিকেজি ধানের দাম পড়ে ৩৬ টাকা। অথচ সরকার প্রতি কেজি ধানের দাম বেঁধে দিয়েছে ৩৩ টাকা। খোলাবাজারের চেয়ে কেজিতে তিন টাকা কম।’
রংপুর মহানগর মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় মিল মালিক সমিতির যুগ্মসম্পাদক সামসুল আলম বাবু সারাবাংলাকে বলেন, ‘কীভাবে ধানের গুণগতমান বজায় রাখা যায়, তা ভালোভাবে জানে না রংপুর বিভাগের অধিকাংশ কৃষক। কৃষকদের কাছ থেকে ধান নিতে হলে অবশ্যই তাদের ভালোমন্দ লক্ষ্য রাখতে হবে। এ নিয়ে আগে আলোচনা করা যেতে পারে। কৃষক যাতে হয়রানির শিকার না হন, সেজন্য খাদ্য অফিস থেকে মিটারের মাধ্যমে আগে ধানের আর্দ্রতা পরিমাপ করতে হবে। এতে অযথা ধান নিয়ে খাদ্যগুদামে যাওয়া-আসার ভোগান্তি ও আর্থিক ক্ষতি থেকে কৃষক রক্ষা পাবেন।’
তিনি বলেন, ‘অনেক সময় দেখা যায়, কোনো জায়গায় ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা উল্লেখ করা আছে। কিন্তু কৃষকের সংখ্যা যদি বেশি হয়, তখন তারা তা নিতে পারেন না। সেক্ষেত্রে লটারি করা হয়। এ অবস্থান থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে।’
আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করেও ধান সংগ্রহ হচ্ছে না। কৃষকরা ধান পরিবহণের ব্যয় কমাতে এবং ধানের গুণগত মান নিয়ে সংশয়ে থাকে। এসব কারণে সরকারি খাদ্যগুদামে ধান বিক্রি করতে আগ্রহী নন তারা। এতে ধানের মজুতে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। ফলে পরোক্ষভাবে চালের ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।’ তবে সরকরিভাবে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তাতে কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করেন তিনি।
সারাবাংলা/পিটিএম