বেরোবির শিক্ষকদের যৌন হয়রানি ও নম্বর জালিয়াতির ঘটনা ফাঁস
২৩ এপ্রিল ২০২৫ ২৩:২২ | আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২৫ ২৩:৫৯
রংপুর: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি ও ফলাফল জালিয়াতির অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়টির একাধিক শিক্ষক এখন সমালোচনার মুখোমুখি। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বেশ কয়েকজন শিক্ষকের মেসেজের স্ক্রিনশট ও অডিও রেকর্ড ফাঁস হওয়ার পর বিষয়গুলো সামনে এসেছে।
এ ছাড়া, বেশ কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পরীক্ষায় নম্বর কম দেওয়া ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত এসব শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবি জানিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করা হচ্ছে। সবমিলিয়ে ক্রমেই দানা বাঁধছে কঠোর আন্দোলনের। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, অভিযোগগুলো লিখিত আকারে পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি ‘সাদিয়া সুভা’ নামে একটি ফেসবুক আইডি থেকে তিনটি অডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ে। এতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. তানজিউল ইসলাম জীবন এবং এক ছাত্রীর ফোনালাপে কুপ্রস্তাবের শর্তে সিজিপিএ বাড়ানোর কথা শোনা যায়। ওই শিক্ষক সেই ছাত্রীকে ৩.১৬ ফলাফল থেকে কীভাবে ৩.৭০ করে দিয়েছেন তা প্রকাশ পায়। অডিওতে শিক্ষক ছাত্রীকে বলছেন, ‘আমি হিসেব-পাতি করেই করেছি (রেজাল্ট বৃদ্ধি)। তোমার বয়স অনেক কম। তুমি প্রথমে চাইছিলা- স্যার আমাকে ফার্স্ট করে দেন।’ আরেকটি অডিও ক্লিপে এই দু’জনের আরও কিছু অসংলগ্ন কথাবার্তা শোনা যায়।
এদিকে পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. রশীদুল ইসলাম ও সহকারী অধ্যাপক অতুল চন্দ্র সিংহের বিরুদ্ধে নম্বর টেম্পারিংয়ের অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর জমা দেন ওই বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা। যেসব অভিযোগ এখন ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ ও প্রোফাইলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অভিযোগে শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা এই দু’জন শিক্ষকের সঙ্গে নম্বর কম দেওয়ার বিষয়ে দেখা করলে তারা আমাদের বিভিন্ন কথা শোনায়। তাই আমরা বাধ্য হয়ে সকল শিক্ষার্থী মিলে অভিযোগ দিয়েছি। যদি না মানা হয় তাহলে আমরা অনশন করব।
এছাড়া, সম্প্রতি ফেসবুকের বিভিন্ন পেইজ ও গ্রুপে পরিসংখ্যান বিভাগের ওই অধ্যাপক ড. রশীদুল ইসলাম ও তার ছাত্রীর মেসেঞ্জারে কথোপকথনের স্ক্রিনশট ফাঁস হলে ক্যাম্পাসে আলোচনার ঝড় ওঠে। বিষয়টি নিয়ে ভুক্তভোগী ছাত্রী ফেসবুকে নিজের আইডি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গ্রুপে দীর্ঘ একটি স্ট্যাটাস লেখেন। পরে সেটি বিভিন্ন পেজে ছড়িয়ে পড়ে। পোস্টে শিক্ষকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করে ছাত্রী বলেন, ‘শিক্ষক রশীদুল স্যারের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছি। তিনি আমার কাছে শাড়ি পরা ছবি চান, কিন্তু আমি দেইনি। এরপর চেম্বারে ডেকে বলেন—‘তোমার কোনো আইডিয়া আছে একজন ভার্সিটি টিচার সম্পর্কে? তোমার পাস-ফেল সবকিছুই আমার হাতে। আমি যেভাবে বলব, তোমাকে সেভাবেই শুনতে হবে। এভাবে তোমার সিনিয়ররাও পাস করে গেছে।’ ওই ছাত্রী আরও লিখেন, ‘আরেকদিন আমাকে চেম্বারে জোর করে ডেকে বলেন ‘তুমি কি জানো ক্লাসে যখন পড়াই, আমার পড়ানো থেকে তোমার দিকে মনোযোগ বেশি থাকে?’
এই দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকের বিরুদ্ধে নম্বর জালিয়াতির অভিযোগ ঘিরে উত্তাল হতে শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয়। যৌন নিপীড়নের দায়ে তাদের প্রশাসনের সব কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি ও বরখাস্তের দাবিতে মশাল মিছিল এবং তাদের কুশপুত্তলিকায় জুতা মারার কর্মসূচিও পালন করেন শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘রশীদুল ইসলাম, ড. তানজিউল ইসলাম জীবন ও অতুল চন্দ্রের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানি ও নম্বর টেম্পারিংয়ের অভিযোগ এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। আমাদের সবার দাবি একটাই, এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত শিক্ষকদের যেন এমন শাস্তি দেওয়া হয়, যাতে ভবিষ্যতে অন্য কেউ এমন ন্যাক্কারজনক কাজ করতে না পারে।’
কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী রহমান আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘যৌন হয়রানির বিষয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা সেল থাকা উচিত। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানি, নম্বর বাড়িয়ে দেওয়াসহ অনেকগুলো বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথপোথন দেখেছি। কিন্তু এখনও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় ধরনের আন্দোলনে নামবে শিক্ষার্থীরা।’
যদিও যৌন হয়রানির বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ড. তানজিউল ইসলাম জীবন। অডিও কল রেকর্ডকে প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি দাবি করে সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘একদল আমার পেছনে অসৎ উদ্দেশ্যে লেগেছে। আর এই রেকর্ডিংটা এআই দিয়ে বানানো।’
এদিকে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ড. তানজিউল ইসলাম জীবন রংপুর তাজহাট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন। ডায়েরিতে উল্লেখ করেন, ‘আমাকে নিয়ে ফেসবুকে সাদিয়া সুভা আইডি থেকে কুরুচিপূর্ণ মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয়েছে। আমার নামে মিথ্যা তথ্য, অপপ্রচারসহ কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে আমাকে সামাজিকভাবে হেয় করা হয়েছে। চেষ্টা করেও অপপ্রচার কারীর পরিচয় শনাক্ত করতে ব্যর্থ হই। সুনির্দিষ্ট তথ্য উপাত্ত না থাকায় বিষয়টি আপাতত সাধারণ ডায়েরিভুক্ত করে রাখা প্রয়োজন।’
অভিযোগ ওঠা পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক রশীদুল ইসলামের মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের নম্বর কম দেওয়ার অভিযোগ ওঠা সহকারী অধ্যাপক অতুল চন্দ্র সিংহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য এসব করেছে। আমি তাদের খাতায় যা পেয়েছি, সেই অনুযায়ী নম্বর দিয়েছি। ওদের পড়ার ধরন ছিল আলাদা, আর আমার পড়ানোর ধরন আলাদা। কোনো অভিযোগই সত্য নয়।’
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. ফেরদৌস রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে পরীক্ষার ফলাফল টেম্পারিংয়ের অভিযোগ এসেছে। এ বিষয়ে আমরা একটা তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছি এবং কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে।’ যৌন হয়রানির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে এখনো কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।’
সার্বিক বিষয়ে উপাচার্য প্রফেসর ড. শওকত আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘যৌন নিপীড়ন তদন্তে একটি সেল গঠন করা হয়েছে। সেখানে যে-কেউ অভিযোগ দিতে পারবেন। আর পরিসংখ্যান বিভাগের যে অভিযোগপত্র এসেছে, সেটির জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে।’
সারাবাংলা/পিটিএম