পর্যবেক্ষক ইস্যু
সংশোধিত নীতিমালা প্রস্তুত, ঐকমত্য কমিশনের দিকে তাকিয়ে ইসি
২৬ এপ্রিল ২০২৫ ২৩:০৫
ঢাকা: ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের লক্ষ্যে একগুচ্ছ কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়ে এগোচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে দেশি-বিদেশি নির্বাচনি পর্যবেক্ষকরা। সেজন্য আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশি-বিদেশি দুই পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে চাইছে ইসি।
এরই মধ্যে গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তৈরি ‘নির্বাচন পর্যবেক্ষক নীতিমালা-২০২৩’ রহিত করে ‘নির্বাচন পর্যবেক্ষক নীতিমালা-২০২৩ (সংশোধিত)’ নামে খসড়া চূড়ান্ত করেছে ইসি। এখন এই ইস্যুতে কাজ এগিয়ে নিতে ঐকমত্য কমিশনের দিকে তাকিয়ে আছে সংস্থাটি।
জানা গেছে, নীতিমালাতে বেশকিছু বিধান যুক্ত করা হয়েছে, আবার কিছু বিয়োজনের মাধ্যমে খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে পর্যবেক্ষক সংস্থা সে সম্পর্কে জানবে, ভোটারের আস্থা ও ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে ভূমিকা রাখবে এবং ভবিষ্যৎ নির্বাচন অধিকতর ভালো করার পরামর্শ ও সুপারিশ দেবেন।
আরও জানা গেছে, নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, সংস্থাগুলো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন বা আছেন, কিংবা কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হলে নিবন্ধনে অযোগ্য হবেন। আর কোনো পর্যবেক্ষক সংস্থার নামের সঙ্গে জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের নামের হুবহু মিল বা কাছাকাছি নাম ব্যবহারের কারণে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্ত তৈরির শঙ্কা থাকলে নিবন্ধনে অযোগ্য হবেন।
এছাড়া, প্রতিটি সংস্থার নিবন্ধন হবে পাঁচ বছর মেয়াদী। সংসদের একটা সাধারণ নির্বাচন ও স্থানীয় সরকারের অন্তত চারটি নির্বাচন পর্যবেক্ষণের পর অভিজ্ঞতার প্রতিবেদন ইসিতে জমা দিতে হবে। সেইসঙ্গে নীতিমালা লঙ্ঘন, রাষ্ট্র বা শৃঙ্খলাবিরোধী কাজে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে ইসির ব্যাখ্যার সন্তোষজনক জবাব না দিলে নিবন্ধন বাতিল হবে। আর বয়স ২৫ বা তদূর্ধ্ব, শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি পাশের নিচে কেউ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক হতে পারবেন না। কোনো রাজনৈতিক দল বা দলের অঙ্গসংগঠন বা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ-সংশ্লিষ্টতা রাখা যাবে না।
তবে নির্বাচনি এলাকার একাধিক পর্যবেক্ষক সংস্থা পর্যবেক্ষণের আবেদন করলে কোন সংস্থা কোন ইউনিটে পর্যবেক্ষণ করবে, সেটি ঠিক করে দেবে কমিশন। আবার সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকার বাসিন্দা বা ভোটার নন, এমন লোককে পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। প্রতিটি পর্যবেক্ষক সংস্থা প্রতি দলে অনধিক পাঁচজন করে একাধিক ভ্রাম্যমাণ পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিতে পারবেন।
আগের নিয়ম অনুযায়ী, পর্যবেক্ষকরা নির্বাচনের সময় সার্বক্ষণিক পরিচয়কার্ড দৃশ্যমান রাখবেন, ভোটারের ভোটদানের প্রতি অধিকতর সচেতন থাকবেন। তিনি ভোটের গোপন কক্ষে প্রবেশ করবেন না। পর্যবেক্ষণের সময় সম্পূর্ণ পক্ষপাতহীনতা বা নিরপেক্ষতা বজায় রাখা এবং কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য বা প্রার্থীর সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত হন, এমন কোনো আচরণ করা যাবে না। কোনো রাজনৈতিক দল, প্রার্থী বা তার এজেন্ট, নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত সংস্থা অথবা ব্যক্তির কাছ থেকে উপহার গ্রহণ বা কেনার চেষ্টা, সুবিধা গ্রহণ বা গ্রহণে উৎসাহিত করা থেকে নিজেকে বিরত রাখা এবং নির্বাচন চলাকালীন পর্যবেক্ষকরা মিডিয়ার সামনে এমন কোনো মন্তব্য করা যাবে না।
এছাড়াও, বিদেশিদের ভোট পর্যবেক্ষণ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে, তাদের অনুমোদনের ক্ষমতা নিজেদের কাছেই রাখতে চায় ইসি। আগে এ ক্ষমতা সরকারের হাতেই ছিল। বর্তমান প্রক্রিয়ায় কোনো বিদেশি পর্যবেক্ষক আসতে চাইলে দূতাবাসের মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। এক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাই করে নো অবজেকশন দিলে নির্বাচন কমিশন অন্য কার্যক্রম সম্পন্ন করে। এতে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ থেকে যায়। কেননা, সরকার বা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক না থাকলে সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা ব্যক্তিকে অনুমোদন দেওয়া হয় না। অতীতে এমন নজির রয়েছে। তাই এই ক্ষমতাটি ইসি তার নিজের কাছেই রাখতে চায়।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার (ইসি) আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেছেন, পর্যবেক্ষক নিয়োগে অনিয়ম অনুসন্ধান ও নীতিমালা পর্যালোচনায় ছয় সদস্যের কমিটি করা হয় জানুয়ারিতে। সেই কমিটি আগামী সংসদ নির্বাচনে কারা পর্যবেক্ষক হতে পারবে কিংবা পারবে না তা যাচাই-বাছাই করে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের নতুন খসড়া নীতিমালা তৈরি করেছে।
তিনি আরও জানান, নীতিমালাতে পর্যবেক্ষক হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা এইচএসসি পাস এবং বিগত সরকারের সময়ে দেওয়া ৯৬ দেশি সংস্থার নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। তবে খসড়া নীতিমালা চূড়ান্ত করার আগে ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদনে এ সংক্রান্ত কী নির্দেশনা আসে সেজন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে বলে জানান ইসি আনোয়ারুল।
তিনি আরও বলেন, ‘আগামীতে নিবন্ধনের শর্তগুলো যথাযথভাবে পূরণসহ পর্যবেক্ষক নিয়োগে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হবে। কারণ, আমরা চাই না ভুঁইফোড় কোনো সংস্থা বা ব্যক্তি এই দায়িত্ব পালন করুক।’
নির্বাচন কমিশনের নতুন পর্যবেক্ষক নীতিমালা বিষয়ে ‘ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্স (ফেমা)’- এর মুনিরা খান সারাবাংলাকে জানান, ইসির নতুন নীতিমালাতে পর্যবেক্ষকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি ও আগের সব সংস্থাকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক। সেইসঙ্গে পর্যবেক্ষকদের প্রশিক্ষণটা বেশি জরুরি বলেও মত দেন তিনি। সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি, তাদের প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল রয়েছে। তাই নতুন করে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সবাইকে প্রশিক্ষণের আওতায় অন্যের জন্য ইসির পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।’
মুনিরা খান আরও বলেন, ‘ভোটের সময় েদখা যায়, কিছু ভুঁইফোড় সংস্থাও চলে আসে। আবার কারও কাছে এটা মৌসুমি ব্যবসার মতো, কিছু ভ্রান্ত ধারণা নিয়েও আসে। তাই এ দিকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।’
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ (জানিপপ) চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা চাই, আন্তর্জাতিকমানের পর্যবেক্ষ। কারণ, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ দক্ষতার বিষয়। এছাড়া, একটা কেন্দ্রেই পর্যবেক্ষক না রেখে ভ্রাম্যমাণ টিম রাখা জরুরি।’ সেইসঙ্গে পর্যবেক্ষকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক হলে ভালো হয় বলে মত দেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের আগে ভোট পর্যবেক্ষণের জন্য প্রথমবারের মতো পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠানের জন্য নিবন্ধন চালু করে নির্বাচন কমিশন। সে সময় ১৩৮টি সংস্থাকে নিবন্ধন দেয় এটিএম শামসুল হুদা কমিশন। প্রথমে সংস্থাগুলোর মেয়াদ এক বছর নির্ধারণ করা হলেও পরে পাঁচ বছরে উন্নীত করে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। ২০১১ সালে নিবন্ধন পায় ১২০ সংস্থা। পরে এসব সংস্থার নিবন্ধনের মেয়াদ ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে শেষ হওয়ার পর আরও এক বছর বাড়ায় কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ কমিশন।
২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আবেদনকারী ১৯৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নিবন্ধন পায় ১১৯টি সংস্থা। তাদের কার্যকালের পূর্ণ মেয়াদ পাঁচ বছর শেষ হলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালে দুই দফায় মোট ৯৬টি দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থাকে নিবন্ধন দেন ইসি। এর আগে, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ওআইসি ও কমনওয়েলথ থেকে ৩৮ জন, বিভিন্ন মিশনের ৬৪ জন এবং বাংলাদেশস্থ বিভিন্ন দূতাবাসে বা হাইকমিশনে কর্মরত বাংলাদেশি ৬১ জন; মোট ১৬৩ জন পর্যবেক্ষক ভোট পর্যবেক্ষণ করেন।
২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসি ৩৪ দেশ ও চারটি সংস্থার শতাধিক পর্যবেক্ষককে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর বিদেশি সাংবাদিক ও বিভিন্ন সংস্থা ১৬৮ জন ভোট দেখতে আসতে পেরেছিলেন। এদের মধ্যে ইসির আমন্ত্রিত ছিলেন মাত্র ১৯ জন।
উল্লেখ্য, প্রতিটি সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য দেশীয় সংস্থাগুলোকে নিবন্ধন নেওয়ার আহ্বান জানায় ইসি। নিবন্ধন পেলে সংস্থাগুলো পরবর্তী পাঁচ বছর স্থানীয় নির্বাচনও পর্যবেক্ষণ করতে পারে। তবে প্রতিটি নির্বাচনের সময় নতুন করে পর্যবেক্ষণের অনুমতি চেয়ে আবেদন করতে হয়।
সারাবাংলা/এনএল/পিটিএম
ইস্যু ঐকমত্য কমিশন নির্বাচন কমিশন পর্যবেক্ষক সংশোধিত নীতিমালা