Monday 28 Apr 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে বসছে কর্ডলাইন, দূরত্ব কমবে ৯০ কিমি

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৮ এপ্রিল ২০২৫ ১০:২৪

বাংলাদেশ রেলওয়ে। ফাইল ছবি

ঢাকা: বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে বলা হয় দেশের দ্বিতীয় রাজধানী। সড়ক পথে ঢাকা-চট্টগ্রামের দূরত্ব ২৮০ কিলোমিটার হলেও রেলপথে এ দূরত্ব ৩২০ কিলোমিটার। এই পথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাতায়াত করতে হয় টঙ্গী-ভৈরব-আখাউড়া ঘুরে। এতে সময় বেশি লাগে। এই বাড়তি সময় কমিয়ে এনে ট্রেনযাত্রা সহজ করতে ঢাকা-লাকসাম কর্ডলাইন নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এখন এর সমীক্ষার কাজ চলছে।

এদিকে এই পথে হাইস্পিড বা দ্রুত গতিসম্পন্ন ট্রেন চালুর যে উদ্যোগ আগে নেওয়া হয়েছিল, তা আপাতত স্থগিত রয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আপাতত কর্ডলাইন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েই এগোচ্ছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে কর্ডলাইন নির্মাণের এ উদ্যোগ অনেক আগের। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে প্রকল্পটি সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল ২০১০ সালে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের আওতায় ২০১২ সালে এই লাইন নির্মাণের একটি প্রস্তাবও তৈরি করেছিল রেলপথ মন্ত্রণালয়। তবে অজ্ঞাত কোনো কারনে সে উদ্যোগ আর এগোয়নি।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কর্ডলাইন নির্মাণে রেলের তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আগ্রহ দেখাননি। উল্টো ওই পথে হাইস্পিড ট্রেন লাইন নির্মাণে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তারা। ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরে হাইস্পিড প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রাথমিক সমীক্ষাও শেষ করে ফেলেন তারা। চায়না রেলওয়ে ডিজাইন করপোরেশন এবং বাংলাদেশের মজুমদার এন্টারপ্রাইজ ওই সমীক্ষা করতে নেয় ১১০ কোটি টাকা। যে কাজ কিছুদিন পরেই বন্ধ রাখার নির্দেশনা আসে। অর্থাৎ ওই ১১০ কোটি টাকা কার্যত জলেই গেছে। লুটপাট হয়েছে বরাদ্দের বেশিরভাগ টাকা।

বিজ্ঞাপন

১১০ কোটি টাকাসহ টঙ্গী-ভৈরব, আখাউড়া-লাকসাম প্রকল্প ঘিরে দুর্নীতির যে অভিযোগ, তা তদন্ত করে লুটেরাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন কর্ডলাইন নির্মাণের পক্ষে থাকা রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা। ওই সময়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ওই সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনাও করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। তারা সরকারেরও ওই উদ্যোগকে উচ্চভিলাষী আখ্যা দিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, বাংলাদেশ রেলওয়ে যেখানে বৈদ্যুতিক রেলসেবা শুরু করতে পারেনি, সেখানে উচ্চগতির রেল পরিচালনার সক্ষমতা কতটুকু?

কর্ডলাইন নির্মাণের পক্ষে থাকা কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সর্বোচ্চ যাত্রী পরিবহণের পাশাপাশি রেলে আয় বাড়তো। যা চলমান ট্রেন দিয়ে যুগ পার হলেও সম্ভব হতো না। বর্তমান চলমান রুটে মাত্র তিন শতাংশ মালামাল ট্রেনে বহণ করা সম্ভব হচ্ছে। বাকি ৯৭ শতাংশ মালামাল সড়ক পথেই পরিবহণ হয়ে থাকে। কর্ডলাইন নির্মাণ হলে রেলে মালামাল পরিবহন বাড়তো প্রায় ৩৭ শতাংশ। সব মিলিয়ে যাত্রী ও মালামাল উভয় দিক থেকেই রেলের আয় বাড়তো বলে জানান রেলসংশ্লিষ্ট সাবেক রেল কর্মকর্তারা।

হাইস্পিড ট্রেনের ভূত অসাধু কর্মকর্তাদের মাথা থেকে নামার পরে ফের আলোচনায় আসে কর্ডলাইন নির্মাণ প্রসঙ্গ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এই প্রকল্পে আগ্রহ দেখানোর পর ২০২০ সালে ২৩৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকার কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এর পর ‘রেলওয়ে কানিক্টিভিটি ইমপ্রুভমেন্ট প্রিপারেটরি ফ্যাসিলিট’ নামের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা-লাকসাম রুটে কর্ডলাইন নির্মাণের জন্য সমীক্ষার কাজ শুরু করা হয়।

জাপান, ফ্রান্স ও মালয়েশিয়ার তিন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের একটি কনসোর্টিয়ামকে এ কাজে নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু ২০২৪ সালে সেই কাজ থেমে যায় তখনকার আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশেই। এর পর গত ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত হয় অন্তবর্তী সরকার। এই অন্তবর্তী সরকারই বন্ধ হয়ে যাওয়া সেই কর্ডলাইন সমীক্ষার কাজ ফের শুরুর উদ্যোগ নেয়। এটি বাস্তবায়নে গেল বছরের নভেম্বরে এসংক্রান্ত একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সে বৈঠক থেকেই সমীক্ষা পুনরায় শুরুর নির্দেশনা আসে।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগের সমীক্ষা যাচাই-বাছাই করে ঢাকা-কুমিল্লা-লাকসাম কর্ডলাইনের জন্য মোট চারটি বিকল্প রুটের কথা উপস্থাপন করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সেখানে অপশন-১ এ , অপশন-১বি, অপশন-২, অপশন-৩ নির্ধারন করা হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রামে পথে বর্তমানে যাতায়াতে সময় লাগে ৫ ঘণ্টার বেশি। এই পথে কর্ডলাইন নির্মাণ হলে সময় কমবে দেড় ঘণ্টা, আর দূরত্ব কমবে প্রায় ৯০ কিলোমিটার।

কর্ডলাইন নির্মাণে এই রুটে সাতটি স্টেশন নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। কর্ডলাইনের অগ্রগতি সম্পর্কে ‘কর্ডলাইন কারিগরি সহায়তা প্রকল্প’র পরিচালক মো. আবিদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের সবশেষ বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এই প্রকল্পে সমীক্ষার কাজ চলমান। এটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে জুনে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সবশেষ বৈঠকে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সমীক্ষা শেষে চূড়ান্ত করা হবে কোন কোন প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা সহজ হবে।’

ঢাকা-চট্টগ্রাম রুট বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ। এ রুটে রেল সংযোগ উন্নয়নে কয়েকবছর ধরেই দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প নিয়ে আলোচনা চলছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ-লাকসাম ডুয়েল গেজ কর্ডলাইন নির্মাণ এবং একটি সম্পূর্ণ নতুন হাই-স্পিড রেলপথ নির্মাণ। যদিও আপাতত হাইস্পিড পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে সরকার। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘কর্ডলাইন নির্মাণ ব্যয় কম, আবার নির্মাণে সময়ও লাগবে কম। অন্যদিকে হাইস্পিড ব্যয়বহুল, সময়ও লাগবে আবার কারিগরি জটিলতা অনেক বেশি।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমান আর্থিক বাস্তবতা, বিদ্যমান রেল নেটওয়ার্কের পরিপ্রেক্ষিতে এবং কার্যকর যাত্রীসেবা নিশ্চিতে নারায়ণগঞ্জ-লাকসাম কর্ডলাইনে টালগো ইন্টারসিটি মডেলটি বেশি উপযোগী। এটি দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য, তুলনামূলক সাশ্রয়ী এবং বহুমাত্রিক ব্যবহারের উপযোগী।’ তিনি আরও বলেন, ‘হাইস্পিড ট্রেনের বিকল্প হিসেবে টালগো ইন্টারসিটি ট্রেন অনেক লাভজনক। এটি প্রচলিত রেললাইনেই অন‍্যান‍্য ট্রেনের পাশাপাশি ১৬০-১৮০ কিলোমিটার গতিতে চলতে সক্ষম। যা আয়তন হিসেবে বাংলাদেশের হাইস্পিড ট্রেনের চাহিদা সাশ্রয়ী মূল‍্যে পূরণ করতে সক্ষম।’ স্পেনিশ প্রযুক্তির যাত্রীবান্ধব বিশেষ ধরনের এই ট্রেন বিশ্বের বহু দেশেই ১১০ থেকে ৩০০ কিমি গতিতে চালু রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

হাই-স্পিড রেল ভবিষ্যতের জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ে বিবেচনায় আনা যেতে পারে সুপারিশ রেখে তিনি বলেন, ‘সরকারের উচিত ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়া। প্রথম ধাপে কর্ডলাইন বাস্তবায়ন করে যাত্রী চাহিদা ও অর্থনৈতিক কার্যকারিতা যাচাই করা।’ একই কথা বলছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক। তিনি বলেন, ‘রেলে অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে। বাংলাদেশ রেলওয়ে এখনো মান্ধাতা আমলের সিস্টেমে চলছে। রেলের পরিবর্তনে ইলেকট্রিক ট্র্যাকশনের কোনো বিকল্প নেই। লোকসান কমিয়ে লাভের মুখ দেখতে হলে রেলকে ঢেলে সাজাতে হবে।’

উল্লেখ্য, গত ১৫ বছরে প্রায় সোয়া এক লাখ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে রেল খাতে। এর মধ্যে ৭২ হাজার কোটি টাকাই খরচ করা হয়েছে নতুন রেলপথ নির্মাণে। গত কয়েক বছরে পদ্মা রেলসংযোগ সেতু সহ চারটি রেলপথ নতুন নির্মাণ করা হয়েছে। চলমান রয়েছে আরও বেশ কয়েকটি নতুন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প। এত খরচের পরেও নতুন রেলপথ, নতুন ইঞ্জিন-কোচে গতি ওঠেনি। অনিয়ম দুর্নীতির কারনে রেলপথে কোটি কোটি ঢালার পরেও সুফল মেলেনি।

সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম

কর্ডলাইন ট্রেন ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর