Tuesday 29 Apr 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গোরখোদকের জীবন
১ কবর খুঁড়লে ৫ টাকা, তাও ‘মেরে দেয়’ ঠিকাদার

উজ্জল জিসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৯ এপ্রিল ২০২৫ ১৮:১১ | আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৫ ২০:৪৩

রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানেে একজন গোরখোদক কবর খুঁড়ছেন। ছবি: সারাবাংলা

ঢাকা: একটি ছোট কবর খুঁড়লে একজন গোরখোদকের জন্য বরাদ্দ থাকে পাঁচ টাকা। মাঝারি কবরের জন্য সাত টাকা আর বড় কবরের জন্য বরাদ্দ নয় টাকা। প্রত্যেক গোরখোদক একজন ঠিকাদারের মাধ্যমে কবর খুঁড়ে থাকেন। কিন্তু গোরখোদকদের জন্য বরাদ্দের সেই টাকাও মেরে দেয় ঠিকাদার। এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানের ঠিকাদার সুমনের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি সারাবাংলার অনুসন্ধানে কবরস্থানে কবর খোঁড়া নিয়ে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

বিজ্ঞাপন

জানা যায়, আজিমপুর কবরস্থানে কবর খোঁড়ার জন্য সকাল ও বিকেল দুই শিফটে ৬০ জন গোরখোদক রয়েছেন। এর মধ্যে সকাল ৬টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ৩০ জন এবং বেলা আড়াইটা থেকে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ৩০ জন কাজ করেন। একেকজনের ভাগে প্রতিদিন ধরতে গেলে একটি করে কবর খোঁড়ার ভাগ পড়ে। একটি ছোট কবর (বাচ্চাদের) খোঁড়ার জন্য ঠিকাদার পাঁচ টাকা, মাঝারি কবরের জন্য সাতটা ও বড় কবর খোঁড়ার জন্য নয় টাকা বরাদ্দ করেছেন। তবে সেই টাকাও গোরখোদকরা পান না বলে অভিযোগ উঠেছে। অর্থাৎ সেই টাকা মেরে খান ঠিকাদার।

বিজ্ঞাপন

আজিমপুর কবরস্থানের অফিস নথি থেকে জানা যায়, ছোট-বড় একটি সাধারণ কবরের জন্য ফি দিতে হয় ১ হাজার ৬৯২ টাকা। এরমধ্যে ঠিকাদার পান ৬৯২ টাকা আর ১ হাজার টাকা পায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ঠিকাদার ওই টাকা থেকে গোরখোদক, বাঁশ এবং চাটাইয়ের ব্যবস্থা করে থাকেন।

এছাড়া, এককালীন পাকা কবরের জন্য বর্তমানে ফি নেওয়া হয় ৬৫ হাজার টাকা। এই টাকার মধ্যে ৫০ হাজার টাকা পায় সিটি করপোরেশন। আর বাকি ১৫ হাজার টাকা ঠিকাদার। তবে ঠিকাদার এই টাকা ইট, বালি, সিমেন্ট, মিস্ত্রি খরচ ও কবর খোড়ার জন্য নিয়ে থাকেন। দুঃখের বিষয় সবার টাকা পরিশোধ করা হলেও কবর খোঁড়ার টাকা পড়ে থাকে বকেয়া।

অভিযোগ রয়েছে, কবরে নিম্নমানের বাঁশ ও চাটাই দিলেও গোরখোদকরদের টাকা কোনোভাবেই দিচ্ছেন না ঠিকাদান সুমন। এক থেকে দেড় বছর হয়েছে সুমন আজিমপুর কবরস্থানের ঠিকাদারি কাজ পেয়েছেন। তবে এর আগে যিনি এই কাজের জন্য ঠিকাদার ছিলেন তিনি ছোট কবর খোঁড়ার জন্য ৬০ টাকা আর বড় কবর খোঁড়ার জন্য ১২০ টাকা দিতেন। কবর খোড়া হয়ে গেলেই সেই টাকা পরিশোধ করে দিতেন। ঠিকাদার বদলের পর থেকেই কবর খোড়ার জন্য কোনো টাকা পাচ্ছেন না গোরখোদকরা।

জানতে চাইলে গোরখোদক জামাই মনির সারাবাংলাকে বলেন, ‘কবর খোঁড়ার টাকা পাই না প্রায় দেড় বছর হলো। এর আগে দিনের টাকা দিনেই পাইতাম। এখন টাকা নামে মাত্র, তাও আবার বকেয়া। চাইলে বলে দিমু এক সময়। বেশি চাইলে ঠিকাদার বলেন, বাড়াবাড়ি করলে চাকরি থাকবে না। এই জন্য টাকা চাই না। শুধু আমি না, এখানকার ৬০ জন গোরখোদকের একই অবস্থা।’

তাহলে আপনারা চলেন কীভাবে? জানতে চাইলে মনির বলেন, ‘কবর দেখাশোনা করলে আত্মীয় স্বজন প্রতিমাসে একটা সম্মানি দেয়। সেটি ২০০ টাকাও দেয় আবার কেউ ৫০০ টাকাও দেয়। সেই টাকা দিয়ে কোনোরকমে চলি। এই লাইনে প্রায় আট বছর ধরে কাজ করছি। নতুন কোনো পেশায় গিয়ে কাজ করব?’

আজিমপুর কবরস্থান। ছবি: সারাবাংলা

আজিমপুর কবরস্থান। ছবি: সারাবাংলা

আপনাদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ আছে যে, মরা মানুষের হাড়গোর বিক্রি করেন আপনারা? এ বিষয়ে জামাই মনির বলেন, ‘এসব মিথ্যা অভিযোগ। আমি কেন? এখানকার কেউই এ কাজ করেন না। একটা কবর খোঁড়ার সময় হাড়গোর বের হলে সেগুলো আলাদা করে রেখে দিই। নতুন লাশ দাফনের পর চাতাই দেওয়া হলে তার ওপর সেই হাড়গোরগুলো দিয়ে মাটি দেওয়া হয়। তাছাড়া পুরো কবরস্থান জুড়ে অসংখ্য সিসি ক্যামেরা রয়েছে। কড়া নির্দেশনা আছে, এ কাজে কেউ জড়িত থাকলে সঙ্গে সঙ্গে তার চাকরি যাবে। এবং তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হবে।’

তাছাড়া, মরা মানুষের হাড়গোর অনেকদিন কবরে থাকলে সেগুলো দিয়ে কোনো কাজ হয় না বলেও জানান এখানকার মানুষরা। জামাই মনিরের কথাগুলোর সত্যতা যাচাই করতে এই প্রতিবেদক আরও কয়েকজন গোরখোদক ও কবরস্থান পরিষ্কারের কাজে নিয়োজিতদের সঙ্গেও কথা বলেন।

কবরস্থানে ঘাস পরিষ্কার করেন শামসুল হক রতন। তিনি বলেন, ‘বাচ্চাদের কবর কম খোঁড়া হয়। দিনের বেশির ভাগ কবরই বড়দের জন্য খোঁড়া হয়ে থাকে। ব্যক্তিগতভাবে কেনা কবর খুঁড়লে সেই মজুরি আত্মীয়-স্বজনই দিয়ে যায়। আর সরকারি কবরের জন্য ফি ঠিকাদার পায়। ঠিকাদার কবর প্রতি নয় টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও একবছরের বেশি সময় হচ্ছে, সেই টাকা আর পাই না। আমরা কবর দেখাশোনা করি। এ বাবদ যার কাছে যা পাই, তাই সবাই মিলে ভাগ করে নিয়ে কোনোরকম দিন চালাই।’

আলাউদ্দিন নামে আরেক গোরখোদক আজিমপুর কবরস্থানে কাজ করেন ১৪ বছর। আগের কবর খনন করলেও বয়সের ভারে এখন আর পারেন না। তাই তিনি কবর দেখাশোনার কাজ করেন। পাহারাও দিয়ে থাকেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এখানকার আয় দিয়ে জীবিকা নির্বাহ খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকে কবর দেখাশোনার জন্য মৌখিক চুক্তি করলেও বছরের পর বছর চলে যায় কেউ আর আসেন না। আবার দুই চার বছর পর অনেকে এসে কিছু দিয়ে যায়। যা পাই তাই লাভ। এভাবে চলছে আমাদের দিনকাল। ঝড়-বৃষ্টি ও বর্ষায় কবর দেখাশোনা করতে হয়। মাটি সরে গেলে তুলে দিতে হয়। নতুন কবরের ক্ষেত্রে এটা বেশি হয়।’

ঠিকাদারের বিষয়ে জানতে চাইলে আলাউদ্দিন বলেন, ‘ঠিকাদার ঠিকই অফিস থেকে টাকা তোলে, কিন্তু আমাদের ফি পরিশোধ করেন না। এটা অন্যায়। কিন্তু এখানে কে করবে কার বিচার। সব বিচার আল্লাহই করেন। এত কবর দেখার পরও যদি ঠিকাদার টাকা মেরে খায় তাহলে আর কিছু বলার নেই।’

ধানমন্ডি থেকে দাফন করতে আসা রবিউল ইসলাম রানা নামে একজনকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘অফিসে ফি বাবদ ১৭০০ টাকা জমা দিয়েছি। এর মধ্যে কবর খোঁড়ার জন্য ৫০০ টাকা। এছাড়া, পানি আনা, খেজুরের ডাল নিয়ে আসা এবং ঠিকাদারের ট্রলি (ট্রলিতে চাটাই ও বাঁশ নিয়ে আসা হয়েছে) বাবদ আরও ৫০০ টাকা দিতে হয়েছে। এর বাইরে কবর দেখাশোনার জন্য প্রতিমাসে আরও এক হাজার করে টাকা দেওয়ার চুক্তি হয়েছে।’

কবর খোড়া ও বাঁশ-চাটাইয়ের জন্য তো ঠিকাদারের টাকা দিয়েছেন, যা ফি’র মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। তাহলে নতুন করে কেন টাকা দিলেন? জবাবে রানা বলেন, ‘তার পরও দিতে হয়েছে, কিছুই বলার নেই। লোক তো আমার মারা গেছে। দাফন তো আমি করেছি। এখন ওনারা যা চেয়েছেন তাই দিয়েছি। হয়তো এই সুযোগটাকেই কাজে লাগান তারা।’

জানতে চাইলে আজিমপুর কবরস্থান অফিসের মোহরা রবিউল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘কেউ মারা গেলে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করতে হলে ফি হিসেবে ১ হাজার ৬৯২ টাকা নেওয়া হয়। এর মধ্যে ঠিকাদার কবরের বাঁশ, চাটাই ও খননের জন্য ৬৯২ টাকা পায়। গোরখোদকদের দায় দায়িত্ব ঠিকাদারের। অফিস কাউকে বেতন ভাতা দেয় না।’

জানতে চাইলে আজিমপুর কবরস্থানের ঠিকাদার সুমন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘টাকা দিই না, এটা ঠিক নয়। অল্প টাকা, তাই বেশি করে জমিয়ে দিই। এতে আমারও সুবিধা, যারা কাজ করেন তাদেরও সুবিধা।’ আপনি ঠিকাদারি কাজ পাওয়ার পর কি দুয়েকবার বিল দিয়েছেন? এর জবাবে তিনি বলেন, ‘একবছরের একটু বেশি সময় হয়েছে, এখনো বিল দিইনি। তবে শিগগিরই গোরখোদকদের বকেয়া বিল পরিশোধ করে দেব।’

আগের ঠিকাদার প্রতি খবর খোঁড়ার জন্য ৬০ টাকা (ছোট কবর) আর ১২০ টাকা (বড় কবর) দিতেন। আপনি পাঁচ টাকা আর নয় টাকা করে দেবেন; এত কম দিচ্ছেন কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই টাকা সিটি করপোরেশন নির্ধারণ করে দিয়েছে। আর এটা গোরখোদকদের সবাই মেনেও নিয়েছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসমাজ কল্যাণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোতালেব সারাবাংলাকে জানান, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত নন। তাই খোঁজ নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করবেন।

সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম

৫ টাকা আজিমপুর কবর গোরখোদক জীবন বরাদ্দ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর