তিতুমীর কলেজ: ২ যুগ ধরে অচল ছাত্র সংসদ, ফান্ডের টাকার হিসাব নেই
১ মে ২০২৫ ২০:১৮ | আপডেট: ১ মে ২০২৫ ২১:৩১
রাজধানী ঢাকার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি তিতুমীর কলেজে দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে ছাত্র সংসদ নির্বাচন। অথচ শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা ও প্রতিনিধি নির্বাচনের এই গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্মটি বন্ধ থাকলেও প্রতি বছর ‘ছাত্র সংসদ ফি’ খাতে নিয়মিতভাবে আদায় করা হচ্ছে লক্ষাধিক টাকা।
বর্তমানে প্রতি বছর তিতুমীর কলেজে ভর্তি হন প্রায় ৫ হাজার শিক্ষার্থী। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে একজন শিক্ষার্থীর জন্য নির্ধারিত ‘ছাত্র সংসদ ফি’ ছিল ২৫ টাকা। এই হারে কয়েক বছর ধরেই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লক্ষাধিক টাকার (প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা) ফি আদায় করা হয়েছে। তবে ছাত্র সংসদের কোনো কার্যক্রম নেই এবং নির্বাচনের কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি।
উল্লেখ্য, কলেজটিতে যখন ডিগ্রি কোর্স ছিল তখন শিক্ষার্থী সংখ্যা আরও বেশি ছিল। সেই সঙ্গে কয়েক বছর আগে বিভিন্ন বিভাগ অনুযায়ী অনার্স-মাস্টার্সে এখনকার চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষার্থীকে ভর্তি করানো হতো। অর্থাৎ আগে আরও অনেক বেশি শিক্ষার্থী ছিল তিতুমীর কলেজে। সে হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া টাকার অঙ্কও ছিল অনেক বেশি।
কিন্তু বছর বছর এতো টাকা নেওয়া হলেও এই মোটা অঙ্কের টাকার কোনো সুনির্দিষ্ট হিসেব নেই। ছাত্র সংসদের ফান্ডে কত টাকা আছে তা জানাতে পারেননি কলেজের শিক্ষক পরিষদের সদ্য সাবেক কোষাধ্যক্ষ ড. মো. রাজিব আহসান। তিনি জানান ফান্ডের বিষয়ে অধ্যক্ষ একক ক্ষমতার অধিকারী। চাপের মুখে কোনো কোনো অধ্যক্ষ ফান্ডের টাকা নড়চড় করতে পারেন এমন আশঙ্কার কথাও জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে, বছর বছর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লক্ষাধিক টাকা উত্তোলন করা এবং ব্যয়ের সুনির্দিষ্ট হিসাব না থাকা বিষয়ে কলেজে সদ্য নিয়োগ পাওয়া অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. ছদরুদ্দীন আহমেদ বলেছেন, আমি নতুন এসেছি, বিষয়টি সম্পর্কে আমারও জানার আছে। এটা ভাবনা-চিন্তার বিষয় বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
এদিকে, তিতুমীর কলেজের সাবেক ভিপি হানিফ অভিযোগ তুলেছেন, এতোদিন ছাত্র সংসদের অর্থ আত্মসাৎ করেছে ছা্ত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
প্রতিবছর নতুন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ২৫ টাকা করে নেওয়া হয় বিষয়ে কলেজের সদ্য সাবেক কোষাধ্যক্ষ ড. মো. রাজিব আহসান বলেন, যে পরিমাণ শিক্ষার্থী ভর্তি হয় সেই পরিমাণ ভর্তি ফি দেয় এটা তো হিসাব করা যায়। তবে বিভিন্ন সময় খরচ হয়। এখানে ২০০-এর অধিক কর্মচারী রয়েছে। বাংলা কলেজ, ঢাকা কলেজের চেয়ে আমাদের কর্মচারীর সংখ্যা দ্বিগুণ। একসময় ৫৮ হাজার শিক্ষার্থী ছিল, তখন সে অনুযায়ী কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তখন আয়ও ছিল, তাই বেতন দেওয়া সহজ ছিল। কিন্তু এখন অতিরিক্ত কর্মচারী হয়ে গেছে, যাদের সরাসরি বেতন দেওয়ার কোনো সোর্স নেই। ছাত্রদের কাছ থেকে বেতন বাবদ কোনো অর্থ নেওয়া হয় বলে আমার জানা নেই।
ছাত্র সংসদের খাত থেকে অর্থ নিয়ে কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হতে পারে বলে ধারণা তার। তিনি আরও বলেন, সেজন্য হয়তো এসব খাত থেকে দেওয়া হয়। যদিও আমি ধারণা থেকে বলছি, তা না হলে কোথা থেকে দেওয়া হয়? এটা তো রেভিনিউ খাত না। সব প্রাইভেটলি নিয়োগ দেওয়া। বিভিন্ন সময় চাপের মুখে নেতারাও নিয়োগ দিয়ে গেছে। আমার জানা মতে কোনটা প্রয়োজন আর কোনটা অপ্রয়োজন সেদিকে যাচ্ছি না। তবে এসব বেতন এই খাত থেকে দেওয়া হতে পারে।
তবে ফান্ডের কত টাকা বেতন বাবদ খরচ করা হয় আর কত টাকা অবশিষ্ট থাকে এবং সেই টাকা কী হয় তা জানাতে পারেননি তিনি।
ছাত্র সংসদের ফান্ডে বর্তমানে কত টাকা আছে? এ বিষয়ে তিনি বলেন, যতটুকু জানি আমাদের যারা সাধারণ শিক্ষক রয়েছেন তারা এটি জানার অধিকার রাখেন না। কারণ তাদের কোনো স্বাক্ষর লাগে না, কোনো জবাবদিহিতা লাগে না। শুধু প্রশাসনের যিনি থাকেন সেই অধ্যক্ষ স্যার একক ক্ষমতার অধিকারী। কোনো অধ্যক্ষ এগুলো (ফান্ডের টাকা) ধরেননি। আবার কেউ কেউ হয়তো নেড়েছেন চাপের মুখে। তা আমার সঠিক জানা নেই। এত সংখ্যক কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের কোন খাত থেকে কীভাবে বেতন দেওয়া হয় সে বিষয়ে প্রশাসনই ভালো জানে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারি তিতুমীর কলেজের সদ্য নিয়োগ পাওয়া অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. ছদরুদ্দীন আহমেদ বলেন, আমি তো কলেজে নতুন জয়েন করেছি। আমাকেও বিষয়টা জানতে হবে কেন এই ফি নেওয়া হয়। এটা তো আসলে ভাবনা-চিন্তার বিষয়।
১৯৬৯-৭০ শিক্ষাবর্ষে তিতুমীর কলেজে প্রথমবারের মতো ছাত্র সংসদ গঠিত হয়। এরপর প্রতিষ্ঠার ৫০ বছরে মাত্র ১০ বার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সর্বশেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬-৯৭ শিক্ষাবর্ষে। নির্বাচিত হয়েছিলেন ভিপি আক্কাছুর রহমান আঁখি (প্রয়াত) এবং জিএস আনোয়ারুল হক আনোয়ার। ছাত্র সংসদের প্রথম ভিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সিরাজউদ্দৌলা এবং জিএস মফিজুল ইসলাম।
তিতুমীর কলেজের সাবেক ভিপি হানিফ অভিযোগ তুলেছেন এতোদিন ছাত্র সংসদের অর্থ ছাত্রলীগ আত্মসাৎ করেছে। তিনি বলেন, ছাত্র সংসদের কার্যক্রম নেই অনেক দিন থেকেই। কিন্তু তারপরেও বছরের পর বছর ছাত্র সংসদের টাকা উঠিয়ে এতোদিন ছাত্রলীগের ছেলেরা খেয়েছে। ছাত্র সংসদ না থাকায় শিক্ষার্থীরা নানান ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। এইজন্য ছাত্র সংসদ খুব দ্রুত দরকার। ছাত্র সংসদের কোনো কার্যক্রম না থাকলে শিক্ষার্থীদের থেকে আদায় করা এই ফি কোথায় যাচ্ছে? ফি দেওয়ার পরেও ছাত্র সংসদের সেবা থেকে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে, এটা নিঃসন্দেহে খারাপ বিষয়।
তিনি আরও বলেন, যত দ্রুত সম্ভব ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জোর দাবি জানাচ্ছি।
এই বিষয়ে কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী আরাফাত রহমান রিয়াদ বলেন, কলেজে ভর্তি হওয়ার পর দেখি ছাত্র সংসদে তালা ঝুলানো। ৫ আগস্টের আগে ছাত্রলীগ এটি দখল করে রেখেছিল। কিন্তু আমরা ভেবেছিলাম এরপর দ্রুত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে, কিন্তু প্রশাসনের কোনো উদ্যোগই দেখছি না। আমাদের থেকে ছাত্র সংসদ ফি নেওয়া হয়েছে, কিন্তু আমরা তার কোনো সুফল পাচ্ছি না। তাই এই ফি দেওয়াটা আমাদের কাছে অর্থহীন মনে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা আশা করি কলেজ প্রশাসন এই বিষয়টির দিকে নজর দেবে এবং যত দ্রুত সম্ভব ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।
সারাবাংলা/এমআর/এসএইচএস