Thursday 01 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গ্যাস সংকটে পোশাক উৎপাদন ব্যাহত
নিজ উদ্যোগে এলএনজি আনতে চায় ব্যবসায়ীরা

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১ মে ২০২৫ ২২:১৫ | আপডেট: ১ মে ২০২৫ ২২:৪০

গ্যাস সংকটে পোশাক উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: একদিকে গরম অন্যদিকে সেচ, এই দুইয়ে মিলে গ্রীষ্ম মৌসুমে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহে। চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতি কমাতে প্রতিবছর লোডশেডিংও দিতে হয়। তবে লোডশেডিং এবার সহনীয় রাখার চেষ্টা করছে সরকার। সেজন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর এটা করতে গিয়ে শিল্প-কারখানায় গ্যাসের সরবরাহ কমাতে হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গ্যাসনির্ভর কয়েকশ’ কারখানা বাধ্য হয়ে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। কোনো কোনো কারখানার উৎপাদন একেবারেই বন্ধ রাখা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নিজ উদ্যোগে এলএনজি আমদানির প্রস্তাব দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ করপোরেশন- পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, এখন দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। বিপরীতে সরবরাহ হচ্ছে ২৭০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ১০৫ কোটি ঘনফুট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। চলতি গ্রীষ্মে মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদনে গুরুত্ব দিতে হচ্ছে সরকারকে। আর এতে গুরুত্ব দিতে গিয়ে গ্যাসের সরবরাহও বাড়াতে হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে। ফলে শিল্প কারখানাগুলোতে সরবরাহ কমেছে।

বিজ্ঞাপন

সারাদেশে বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানার সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। এর মধ্যে গাজীপুর শিল্পাঞ্চল, সাভার, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ এলাকায় কারখানার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আবার এগুলোর মধ্যে গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে বেশি কারখানা। সূত্র জানায়, গাজীপুর জেলায় ২ হাজার ১৭৬টি কারখানার মধ্যে পোশাক কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ১৮৭টি। লাইসেন্স নেই এমন কারখানার সংখ্যাও কম নয়। এসব কারখানার বেশিরভাগের-ই উৎপাদন গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু গ্যাস সরবরাহ ঘাটতির কারণে অনেক কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। সেজন্য গত এক মাস ধরে পোশাক উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

তারা বলছেন, গত চার/পাঁচদিন ধরে গাজীপুর এলাকায় গ্যাস সরবরাহ নেই বললে চলে। গ্যাস সরবরাহ না থাকায় অনেক কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন- বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘তিন থেকে চারদিন ধরে আমার কারখানায় গ্যাস নেই। দু’দিন আগে পাকিস্তানের একটি ব্যবসায়িক দল আমার কারখানা পরিদর্শনে আসেন। তারা এসে দেখেন কারখানার ডায়িং মেশিন বন্ধ। তারা জানতে চেয়েছেন কেন বন্ধ। আমি বলেছি গ্যাসের সমস্যা হচ্ছে, যে কারণে বন্ধ রয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই যে উৎপাদন কম হচ্ছে, আবার কারখানা বন্ধ রাখা হচ্ছে। ফলে সময় মতো আমরা পণ্য ডেলিভারি দিতে পারছি না। এতে বায়ারের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হচ্ছে।’

এদিকে শিল্প-কারখানায় গ্যাস সংকট জানিয়ে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান বরাবরে কারখানা মালিকদের পক্ষ থেকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে সম্প্রতি দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, গ্যাস সংকটের কারণে গত কয়েকদিনে গ্যাসনির্ভর কারখানাগুলো পূর্ণ ক্ষমতায় উৎপাদনে যেতে পারছে না। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প থেকে বিদেশি রফতানিকারকরা মুখ ফিরিয়ে নেবে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সঙ্গে তৈরি পোশাক শিল্প ব্যবসায়ীরাও দেখা করেছেন। বুধবার (৩০ এপ্রিল) সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ বেশ কয়েকটা সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এ প্রসঙ্গে বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘আমরা আমাদের গ্যাস সংকটের কথা জ্বালানি উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরেছি। উপদেষ্টা বলেছেন, গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে হলে আমদানি বাড়াতে হবে। আমদানি না বাড়লে সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব না। আমরা বলেছি সার উৎপাদনে গ্যাস সরবাহ বন্ধ করা যেতে পারে, কারণ সার আমদানি করা যায়। কিন্তু আমাদের পোশাক শিল্পে আমদানির সুযোগ নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিদ্যুতে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে আমাদের সরবরাহ কমিয়ে। বিদ্যুতে গ্যাস সরবরাহ আরেকটু কমাতে পারেন। আমরা একটা প্রস্তাব দিয়েছি। সেটা হলো- আমরা এলএনজি আমদানিতে ফাইন্যান্স করব। মানে সরকার অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এলএনজি আমদানিতে টাকা পাচ্ছেন না। আমরা বলেছি এলএনজি আমদানিতে আমরা টাকা দেব। প্রয়োজনে আমাদের বিল ডলারে নিন। কিন্তু আমাদের গ্যাস নিশ্চিত করুন। আলোচনা করে সরকারের পক্ষ থেকে জানানোর কথা বলেছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা।’

বিকেএমইএ’র সভাপতি বলেন, ‘আমরা বলেছি, এই জ্বালানি জাতিয় গ্রিডে দেওয়া যাবে না। এটা যেহেতু আমরা ফাইনান্স করব, সেহেতু এটা শুধু আমাদের সরবরাহ করতে হবে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিতাস ও পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন জ্বালানি উপদেষ্টা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের প্রস্তাবটা ভাবা হচ্ছে। এখন কোন প্রক্রিয়ায় বিষয়টা প্রয়োগ করা যায় সেটা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও আলোচনা হবে।’

এদিকে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, দেশের অন্যতম বড় শিল্পাঞ্চল গাজীপুরের কারখানাগুলোতে প্রতিদিন ছয়শ’ থেকে সাতশ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন হয়। সেখানে সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। তিতাসের উপ-মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী ফারুক জানান, পেট্রোবাংলা যতটুকু সরবরাহ করে তিতাসও ততটাই সরবরাহ করে থাকে। তিনি বলেন, ‘শুধু শিল্প কারখানাতেই নয়, আবাসিকেও গ্যাস সমন্বয় করে দিতে হচ্ছে।’

শিল্পমালিকরা বলছেন, সময়মতো পণ্য রফতানি করতে পারায় ক্রয়াদেশ বাতিল হচ্ছে। রফতানিকারকরা অন্যদেশে ঝুঁকছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি কারখানার বয়লার চালানোর জন্য প্রতি ঘনফুটে ১৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ প্রয়োজন হলেও গ্যাস সংকট থাকার কারণে এখন ১ থেকে ২ পিএসআই এ নেমেছে। ফলে বড় কারখানাগুলো উচ্চমূল্যের ডিজেল দিয়ে জেনারেটর ব্যবহার করছে। আর ছোট কারখানাগুলোর অধিকাংশ উৎপাদন বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

কয়েকদিন আগে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছিলেন, এবার গ্রীষ্ম মৌসুম সামাল দিতে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহে কিছুটা সমস্যা তৈরি হবে। তাই, এবার বিদ্যুতে লোডশেড করতে হবে। তবে, চেষ্টা থাকবে সহনীয় পর্যায়ে রাখা। সেক্ষেত্রে চাপ পড়বে গ্যাস ক্ষেত্রে।

এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবার চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা ১৮ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে সরবরাহ ১৫ থেকে সাড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের মতো হচ্ছে বলে জানা গেছে।

সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম

আমদানি এলএনজি গ্যাস সংকট পোশাক উৎপান ব্যবসায়ীরা ব্যাহত