নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে মিত্রহীন হয়ে পড়ছে বিএনপি!
২ মে ২০২৫ ১০:০২ | আপডেট: ২ মে ২০২৫ ১২:২০
ঢাকা: আগে নির্বাচন, নাকি সংস্কার— গুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যুতে রাজনীতির মাঠে মিত্রহীন হয়ে পড়ছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএনপির বাইরে বড় তিন রাজনৈতিক শক্তি ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’, ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’ এবং ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)’ সংস্কার এবং আওয়ামী লীগের বিচার না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের বিপক্ষে। কিন্তু, বিএনপি চায় দ্রুত সংস্কার শেষ করে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন!
বিএনপি বারবার বলে আসছে, সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া। সুতরাং নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ ও জনপ্রশাসনের প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত শেষ করে নির্বাচনের দিকে এগোতে হবে। দেশের স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র ও জননিরাপত্তার নিশ্চিত করতে নির্বাচিত সরকারের কোনো বিকল্প নাই। নির্বাচন যত বিলম্বিত হবে, সংকট তত বাড়বে। তাছাড়া সব বিষয়ের সংস্কার করার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। তারা বড়জোর সংস্কার প্রস্তাবগুলো রেখে যেতে পারে। পরবর্তী সময় নির্বাচিত সরকার এসে এ সংস্কার সম্পন্ন করবে।
কিন্তু, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সংস্কার ছাড়া নির্বাচন দিলে সে নির্বাচনে জনরায়ের প্রতিফলন ঘটবে না। নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, জনপ্রশাসনসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের আগে নির্বাচন হলে ফের ‘স্বৈরতন্ত্র’ ও ‘ফ্যাসিজম’র জন্ম হতে পারে। এ কারণে আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন চান তারা। এ ইস্যুতে এই তিন বড় শক্তি শুরু থেকেই ঐকমত্য পোষণ করে আসছে।
এ কারণে আওয়ামী লীগ ‘ঠেকাও’ আন্দোলনে বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন এবং এনসিপি কোনো ওজর-আপত্তি ছাড়াই একমত পোষণ করলেও সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যুতে তারা এক হতে পারছে না। এক্ষেত্রে জামায়াত-ইসলামী আন্দোলন এবং এনসিপি একদিক আর বিএনপি একা একদিক। এই জায়াগাটাতে এসে মিত্রহীন হয়ে পড়েছে বিএনপি।
শুধু মিত্রহীন নয়, ভাষণ-বক্তৃতায় তিন দলের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হচ্ছে বিএনপি। প্রায় প্রতিদিনই জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন এবং এনসিপি নেতারা বিএনপির ‘দ্রুত’ নির্বাচনের দাবির তীব্র সমালোচনা করছেন। এ সমালোচনায় এনসিপির তরুণ নেতারা শুধু নয়, জামায়াত এবং ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতারাও শরিক হচ্ছেন। তার বারবার বলার চেষ্টা করছে, বিদ্যমান অবস্থায় নির্বাচন হলে রাজনীতির গুণগত কোনো পরিবর্তন হবে না। আওয়ামী লীগের জায়গায় জাস্ট বিএনপি এসে বসবে।
রাজনীতির মাঠে শক্তিশালী তিন দলের কাছে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে বিএনপি। অনেক দৌড়-ঝাঁপ, দেন-দরবার এবং বৈঠক করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। এ বছর ২৭ জানুয়ারি ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের সঙ্গে দেখা করে বিএনপির বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য না দেওয়ার অনুরোধ জানান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
ওই অনুরোধের পরও নিজেদের অবস্থান খুব একটা পরিবর্তন করেনি ইসলামী আন্দোলনের নেতারা। বরং তাদের অবস্থান আরও জোরাল করেছে। বিশেষ করে সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যুতে হার্ডলাইনে অবস্থান করছে দলটি। শনিবার (২৬ এপ্রিল) গণমিছিলপূর্ব সমাবেশে ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম ঘোষণা দিয়েছে ‘আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন’-এর দাবিতে অচিরেই ‘মার্চ ফর ঢাকা’ কর্মসূচি পালন করবে ইসলামী আন্দোলন।
এদিকে শুরু থেকেই ‘সংস্কার শেষে নির্বাচন’— এর পক্ষে অবস্থান নেওয়া জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ গত ১৬ এপ্রিল হঠাৎ তাদের অবস্থান পরিবর্তনের আভাস দিলেও পরের দিন সেটা শুধরে নেয়। সে সময় ঢাকায় সফররত মার্কিন ডেপুটি হেড অব মিশনের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোল চুলিকের সঙ্গে বৈঠক শেষে ড. শফিকুর রহমান বলেন, ‘তারা (মার্কিন প্রতিনিধি দল) শুধু এটাই জানতে চেয়েছে, কখন আমরা এই নির্বাচন অনুষ্ঠানটা দেখতে চাচ্ছি। আমরা বলেছি যে, প্রধান উপদেষ্টা চলতি বছরের ডিসেম্বর অথবা আগামী বছরের জুনের মধ্যে ইলেকশন দেওয়ার কথা বলেছেন। তার কমিটমেন্টে তিনি ঠিক আছেন কি না, তা আমরা দেখতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের ভিউ হচ্ছে, এটা (জাতীয় সংসদ নির্বাচন) রমজানের আগেই শেষ হয়ে যাক। ওই জুন পর্যন্ত অপেক্ষা, কখনো বর্ষা, ঝড়ঝাপটা, বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসবে, তখন আবার ইলেকশনটা না হওয়ার আশঙ্কা দেখা যাবে। তাই আমরা চাচ্ছি, ওই আশঙ্কার আগেই, রমজানের আগেই এইটা (সংসদ নির্বাচন) হয়ে যায়, সেটা আমাদের মতামত।’
জামায়াত তাহলে আগামী রোজার আগেই নির্বাচন চাইছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, শুধু আগামী না। আগামীতে অনেক রোজাই আসবে। ২০২৬ সালে যে রমজান আসবে সেই রমজানের আগেই নির্বাচনটা হয়ে যাক, সেটা আমরা চাই।’
জামায়াত আমিরের এই বক্তব্য রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কৌতুহলের জন্ম দেয়। অনেকেই বলতে থাকেন দেরিতে হলেও নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে কাছাকাছি এসেছে জামায়াত-বিএনপি। কিন্তু, পরের দিনই আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন ডেকে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান পরিষ্কার বলে দেন, নির্বাচন ইস্যুতে সরকারকে কোনো প্রকার চাপ দেবে না তার দল। এর পর গত দশ দিনে জামায়াতের নেতারা তাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে সংস্কারের পরে নির্বাচনের বিষয়টি বারবার সামনে নিয়ে আসছেন।
এনসিপি নেতারা আগে থেকে সংস্কার এবং আওয়ামী লীগের বিচার শেষ হওয়ার আগে নির্বাচন আয়োজনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। গত ১০ দিন ধরে চালিয়ে যাওয়া সভা-সমাবেশে তারা বারবার বলছেন, সংস্কার এবং আওয়ামী লীগের বিচার ছাড়া কোনো অবস্থাতেই নির্বাচন মেনে নেওয়া হবে না।
নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে এই মুহূর্তে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় ‘বড়’ শক্তিগুলোর এ ধরনের কঠোর অবস্থানে বিএনপি একাবোধ করছে কি না?— এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রত্যেকটা দলেরই নিজস্ব রাজনীতি আছে। তাদের জন্য যেটা ভালো, তারা সেটা চাচ্ছে। বড় দল হিসেবে জনগণের জন্য যেটা ভালো, আমরা সেটা চাচ্ছি। যে দলের সঙ্গে জনগণ থাকে, সে দল কখনো একাবোধ করে না।’
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম