Sunday 04 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চা শ্রমিক: কবে মিলবে ন্যায্যতা?

সফিউল ইসলাম
৪ মে ২০২৫ ১৪:১৫

বাংলাদেশের সবুজ গালিচার মতো বিস্তৃত চা বাগানগুলো দেশের অর্থনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এই মনোরম দৃশ্যের নেপথ্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন লক্ষ লক্ষ চা শ্রমিক। তাদের হাতের স্পর্শে ফোটে ওঠে সুগন্ধি চা পাতা, যা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও সমাদৃত। অথচ, এই চা শ্রমিকদের জীবন বহু বছর ধরে অবহেলিত, অধিকার বঞ্চিত এবং ন্যায্যতার প্রতীক্ষায় প্রহর গোনে। কবে তাদের জীবনে আসবে সেই সোনালী সকাল, যখন তারা মর্যাদা ও সম্মানের সাথে জীবনধারণ করতে পারবে? চা শ্রমিকদের অধিকারের প্রশ্নটি দীর্ঘদিনের।

বিজ্ঞাপন

ঔপনিবেশিক শাসনের সময় থেকেই তাদের শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস শুরু। সেই সময়ে, মুনাফালোভী বাগান মালিকরা শ্রমিকদের স্বল্প মজুরি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস এবং অমানবিক পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করত। স্বাধীনতার দীর্ঘ বছর পরেও সেই চিত্রের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। যদিও সময়ের সাথে সাথে কিছু আইন ও নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে, কিন্তু মাঠ পর্যায়ে তার কার্যকর প্রয়োগ আজও সুদূর পরাহত। বর্তমানে, চা শ্রমিকরা যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হন, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হল স্বল্প মজুরি। দৈনিক মজুরি এখনও এমন এক স্তরে আটকে আছে, যা দিয়ে ন্যূনতম জীবনধারণ করাও কঠিন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তাদের সামান্য আয় আরও অপ্রতুল হয়ে পড়েছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে তাদের প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হয়। অপুষ্টি, রোগব্যাধি এবং শিক্ষার অভাব তাদের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তোলে। চা বাগানগুলোতে শ্রমিকদের জন্য যে আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়, তাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানসম্মত নয়। জরাজীর্ণ, স্যাঁতসেঁতে এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে বসবাস করতে বাধ্য হন তারা। পানীয় জলের অভাব এবং পয়ঃনিষ্কাশনের দুর্বল ব্যবস্থা তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়। শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় খেলার মাঠ বা শিক্ষার সুযোগ সেখানে অপ্রতুল। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও চা শ্রমিকরা চরম বৈষম্যের শিকার। বাগান এলাকায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অভাব অথবা থাকলেও সেখানে পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও ঔষধের সরবরাহ থাকে না। ফলে, সাধারণ রোগব্যাধিও অনেক সময় জটিল আকার ধারণ করে এবং অকালে প্রাণহানি ঘটে। গর্ভবতী মহিলা ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে। শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড। অথচ, চা শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য শিক্ষার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। বাগান এলাকায় বিদ্যালয়ের অভাব, বিদ্যালয়ে যাতায়াতের অসুবিধা এবং দারিদ্র্যের কারণে অনেক শিশুই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে, তারা বংশ পরম্পরায় সেই একই শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হতে থাকে। এই দুষ্টচক্র ভাঙা অত্যন্ত জরুরি। আইনের শাসনের অভাব এবং শ্রমিক অধিকার বাস্তবায়নে দুর্বলতা চা শ্রমিকদের দুর্দশার অন্যতম কারণ। যদিও বাংলাদেশ শ্রম আইনে শ্রমিকদের কিছু অধিকারের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু চা বাগানগুলোতে তার যথাযথ প্রয়োগ দেখা যায় না। শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর দুর্বলতা এবং মালিকপক্ষের প্রভাবের কারণে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে তেমন একটা সুবিধা করতে পারে না। চা শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। সরকার, বাগান মালিক, শ্রমিক ইউনিয়ন এবং নাগরিক সমাজ—সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে। মজুরি বৃদ্ধি, মানসম্মত আবাসন, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন এবং তার কঠোর বাস্তবায়ন জরুরি।

বিজ্ঞাপন

মজুরি বোর্ডের নিয়মিত সভা আহ্বান এবং শ্রমিক প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি ন্যায্য মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করা প্রয়োজন। দ্রব্যমূল্যের সাথে সঙ্গতি রেখে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি করা অত্যাবশ্যক। পাশাপাশি, শ্রমিকদের জন্য উন্নতমানের আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি বাগানে পর্যাপ্ত সংখ্যক স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন এবং সেখানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও ঔষধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। চা শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা অপরিহার্য। প্রতিটি বাগান এলাকায় পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। দরিদ্র শ্রমিক পরিবারের সন্তানদের জন্য শিক্ষা উপকরণ ও আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়। শ্রমিক ইউনিয়নগুলোকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। শ্রমিকদের অবাধে সংগঠিত হওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের দাবি দাওয়া পেশ করার সুযোগ দিতে হবে। মালিকপক্ষকে শ্রমিকদের সাথে একটি সুস্থ ও গণতান্ত্রিক আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সরকারকে শ্রম আইন সংশোধন এবং তার কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে চা শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। শ্রম পরিদর্শকদের নিয়মিত বাগান পরিদর্শন এবং আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চা শিল্পে একটি জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছতাভিত্তিক কর্মপরিবেশ তৈরি করা জরুরি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও চা শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং বাগান মালিকদের শ্রমিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে উৎসাহিত করতে পারে। চা শ্রমিকরা শুধু শ্রমিক নন, তারা এ দেশের নাগরিক এবং তাদেরও মৌলিক মানবাধিকার রয়েছে। একটি সভ্য ও ন্যায়সঙ্গত সমাজে কোনো নাগরিকই শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হতে পারে না। চা শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করা শুধু তাদের ব্যক্তিগত কল্যাণ নয়, বরং একটি সুস্থ ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য অপরিহার্য। কবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসবে, যখন চা শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবে? কবে তারা মাথা উঁচু করে সম্মানের সাথে বাঁচতে পারবে? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং আন্তরিক সদিচ্ছার উপর। আসুন, আমরা সকলে মিলে চা শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াই এবং তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শামিল হই। তাদের মুখের হাসিই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

লেখক: শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ

সারাবাংলা/এএসজি

চা শ্রমিক মুক্তমত সফিউল ইসলাম

বিজ্ঞাপন

গ্লিজবী ডেজার্ট
৪ মে ২০২৫ ১৮:৩১

আরো

সম্পর্কিত খবর