Sunday 04 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জনতার পুলিশ: প্রত্যাশা ও বাস্তবতা

ফাহিম হাসনাত
৪ মে ২০২৫ ১৭:১৬ | আপডেট: ৪ মে ২০২৫ ১৭:৩৫

প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও পুলিশ সপ্তাহ সাড়ম্বরে পালিত হয়েছে। এ আলোচনা সভায় পুলিশ মহাপরিদর্শক তার বক্তব্যে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, দেশের মানুষ পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত এবং জনগণের পুলিশ হিসেবে দেখতে চায়। অপরাধীদের জন্য পুলিশ হবে আতঙ্কের কারণ, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে তারা ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সম্মানের প্রতীক হবে—এমনটাই প্রত্যাশা। তবে এই বক্তব্য যেন শুধু কথার ফুলঝুরি না হয়ে বাস্তবেও প্রতিফলিত হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

বিজ্ঞাপন

অতীতে বহু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি পুলিশকে জনবান্ধব বাহিনীতে রূপান্তরিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু কার্যত কোনো পরিবর্তন আসেনি। পুলিশ বাহিনী সেই আগের অবস্থাতেই রয়ে গেছে। জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থান দমনের সময় তৎকালীন স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্য যেভাবে নির্বিচারে সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে, সেই দৃশ্য আজও মানুষের স্মৃতিতে অমলিন। অতীতে অনেক পুলিশ কর্মকর্তাই বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে অথবা সরকারের আনুকূল্য লাভের আশায় নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। এর সবশেষ উদাহরণ হলো জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সময়কার হত্যাকাণ্ড।

বিজ্ঞাপন

পুলিশ কেবল রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি অংশ নয়, এই বাহিনী সমাজেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। কিন্তু প্রায়শই দেখা যায়, যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, পুলিশ সেই দলের অনুগত হয়ে তাদের অবৈধ ও অনৈতিক আদেশ মেনে চলে এবং সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে দমনমূলক পদক্ষেপ নেয়। এই অবস্থা থেকে মুক্তি না পেলে, যতই সভা-সেমিনার করে ভালো কথা বলা হোক না কেন, তাতে কোনো লাভ হবে না। পুলিশের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব কমাতে হলে সমস্যার গভীরে যেতে হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুলিশের অপব্যবহার বন্ধ করে এই বাহিনীকে স্বাধীনভাবে ও আইন মেনে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। পুলিশকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে কখনোই জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী গঠন করা সম্ভব নয়। পুলিশের প্রতি জনসাধারণের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে তৈরি করা যায়, তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। ধাওয়া, লাঠিপেটা ও জলকামান ব্যবহারের বাহিনী নয়, পুলিশকে দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল একটি বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

একটি রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের ভূমিকা অপরিহার্য। তারা জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, অপরাধ দমন করে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। তবে দুঃখের বিষয় হলো, যখন এই বাহিনী রাজনৈতিক প্রভাবের অধীনে পরিচালিত হয়, তখন তাদের নিরপেক্ষতা, পেশাদারিত্ব এবং জনগণের আস্থা প্রশ্নের মুখে পড়ে। বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশে পুলিশ রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ।

বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি সরকারই ক্ষমতায় এসে পুলিশ বাহিনীকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছে। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বিরোধীদের দমন, রাজনৈতিক মামলায় হয়রানি, নির্বাচনী সময়ে প্রশাসনিক পক্ষপাত—এসবই পুলিশ বাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থা দুর্বল করেছে। যখন পুলিশ রাজনৈতিক নির্দেশে কাজ করে, তখন আইনের শাসন লঙ্ঘিত হয় এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করে।

দেশের মানুষ চায় পুলিশ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকুক। গত বছর ডিসেম্বরে পুলিশ সংস্কার কমিশনের পরিচালনায় ‘কেমন পুলিশ চাই’ শীর্ষক জনমত জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ৮৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশ দেখতে চায়। আর ৮৯ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ মনে করে, পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের বিষয়টিতে জরুরি সংস্কার প্রয়োজন। সম্প্রতি পুলিশ সপ্তাহ ২০২৫ উপলক্ষে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ‘নাগরিক ভাবনায় জনতার পুলিশ: নিরাপত্তা ও আস্থার বন্ধন’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বিশিষ্টজনেরা একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাই এই বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

পুলিশকে জনতার মুখোমুখি নয়, বরং তাদের পাশে থাকতে হবে। তবেই তারা জনগণের বন্ধুতে পরিণত হবে। অন্যথায় তারা কখনোই জনগণের পুলিশ হতে পারবে না। যদি পুলিশ সত্যিকার অর্থে জনগণের পাশে থাকে, তবে তারা ভয়ের প্রতীক না হয়ে ভরসা ও নির্ভরতার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠবে। এই কাজটি বাস্তবায়ন করতে পারলেই পুলিশের প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক হবে। যখন মানুষ দেখবে যে বাহিনীটি কেবল আইন প্রয়োগ করছে না, বরং জনগণের অধিকার রক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধ বজায় রাখার দায়িত্বও নিচ্ছে, তখন তাদের প্রতি আস্থা, শ্রদ্ধা ও সম্মান জন্মাবে।

রাষ্ট্র যখন নিপীড়ক হয়ে ওঠে, তখন পুলিশকে জনতার হতে দেয় না। পুলিশকে জনগণের পুলিশ হতে হলে কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, স্বাধীন কমিশন গঠন করে নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি স্বচ্ছ ও পেশাগত মানদণ্ডে নির্ধারণ করতে হবে। সেই সঙ্গে আইনকে যুগোপযোগী করে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রতিরোধের সুস্পষ্ট বিধান রাখতে হবে।

জনগণের কাছে পুলিশের কার্যক্রমের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে এবং যেকোনো অভিযোগের দ্রুত তদন্ত করতে হবে। পুলিশি কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে জনমত সৃষ্টি ও প্রতিবাদ জানানোও জরুরি। সর্বোপরি, পুলিশের ন্যায়-অন্যায় বিচারের মতো বুদ্ধিমত্তা থাকতে হবে। বিগত স্বৈরাচারী সরকার পুলিশ বাহিনীকে দলীয় কাজে ব্যবহার করে জনগণের আস্থা পুরোপুরি হারিয়েছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুলিশের অপব্যবহার বন্ধ করার এখনই উপযুক্ত সময়। যদি পুলিশ স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পায়, তাহলে তাদের ভাবমূর্তি অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে। আর এই সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব বর্তমান সরকারের।

পুলিশ বাহিনী রাষ্ট্রের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। যদি এই বাহিনী রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করে, তাহলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেমন উন্নতি ঘটবে, তেমনি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারও সুরক্ষিত থাকবে। এখন সময় এসেছে, পুলিশ বাহিনীকে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে তুলে একটি নিরপেক্ষ ও পেশাদার প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এএসজি

জনতার পুলিশ পুলিশ ফাহিম হাসনাত মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর