জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় স্থানীয়দের অংশগ্রহণ জরুরি
৬ মে ২০২৫ ১৪:৫৪
সম্প্রতি বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই সংকটের সবচেয়ে বড় শিকার হতে পারে বাংলাদেশ। এটি একটি জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, খরা, লবণাক্ততা ইত্যাদি সমস্যা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। দেশের অবস্থান এই সংকটকে আরও চ্যালেঞ্জিং করে তুলছে। জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয়দের অভিজ্ঞতা ও মতামত উপেক্ষিত থাকে। বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে কোনো সমাধান পেলে, তা টেকসই ও কার্যকর হতে পারে।
প্রতিটি অঞ্চলের স্থানীয় মানুষ তাদের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানে। তারা জানে কোথায় কখন বৃষ্টি হয়, কোথায় নদী ভাঙে, কোন সময়ে খরা বাড়ে এবং কোথায় লবণাক্ততা বাড়ছে। স্থানীয় মানুষ এসব জ্ঞান তাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে অর্জন করে। এই ধরনের নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ করা কোনও জরিপে প্রায় অসম্ভব। সুতরাং জলবায়ু পরিকল্পনায় স্থানীয় জ্ঞানকে গুরুত্ব দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়, ‘স্থানীয় জ্ঞান হলো বাস্তবতার আয়না’।
বর্তমানে অধিকাংশ জলবায়ু নীতি কেন্দ্রিক এবং ঢাকায় বসে প্রণীত হয়। ফলে স্থানীয় বাস্তবতা প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে। অধিকাংশ সরকারি প্রকল্পের উদ্দেশ্য থাকে শুধুমাত্র পরিসংখ্যান পূর্ণ করা, মানুষের প্রকৃত সমস্যার সমাধান নয়। যেমন বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু স্থানীয়দের মতামত ছাড়াই। এতে পরিবেশের ক্ষতি এবং স্থানীয়দের আয়ের উৎসও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্থানীয়দের অংশগ্রহণ ছাড়া এসব প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদী সমাধান দিতে সক্ষম হয় না।
যদি কোনো জলবায়ু প্রকল্প গ্রহণের আগে স্থানীয়দের মতামত নেওয়া হয়, তবে প্রকৃত সমস্যাগুলো উন্মোচিত হতে পারে। স্থানীয়রা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক সমাধান দিতে পারে। এতে খরচ কমে এবং টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হয়। এক উপকূলবাসী বলেছিলেন, ‘যে সিদ্ধান্তে আমি থাকি না, সে সিদ্ধান্ত আমার নয়।’
স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, এনজিও কর্মী ও কৃষক ইত্যাদি অনেক সময় জলবায়ু ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন থাকে। তারা ছোট পরিসরে নানা উদ্যোগ নেয়। তাদের এই উদ্যোগগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। স্থানীয় নেতাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো প্রয়োজন। কারণ তাদের নেতৃত্বে পরিচালিত প্রকল্পের সাফল্যের হার অনেক বেশি থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, স্থানীয়ভাবে পরিচালিত প্রকল্পগুলো অধিক কার্যকর ও টেকসই হয়। এতে মানুষের মালিকানা অনুভূতি থাকে। যেটা প্রকল্পের সফলতার জন্য অপরিহার্য।
সাতক্ষীরা একটি গ্রামের ঘটনা এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এখানে স্থানীয় মানুষরা নিজেদের উদ্যোগে পুকুর খনন করে পানির সংকট দূর করেছে। তারা জানত, কোথায় খনন করলে পানি থাকবে এবং কোন সময়ে খনন করা ভালো। এখানে কোনো সরকারি সহায়তা ছিল না। ছিল শুধু স্থানীয়দের ঐক্য।
তবে স্থানীয়দের মতামত নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাব এবং স্থানীয় অভিজাত শ্রেণির পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষের মতামত উপেক্ষিত হতে পারে। এ ছাড়া নারীদের মতামত প্রায়শই শোনা হয় না। এ কারণে অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া গ্রহণের আগে কিছু শর্ত মেনে চলা জরুরি।
স্থানীয়দের মতামত সংগ্রহের ক্ষেত্রে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। মতামত গ্রহণের প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ এবং সবার জন্য উন্মুক্ত হতে হবে। স্থানীয়দের মতামত লিখিতভাবে নথিভুক্ত করা উচিত। যাতে তা ভবিষ্যতে সহায়ক হতে পারে। নীতিনির্ধারকদের উচিত স্থানীয়দের মত শোনা এবং তা নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা। শুধুমাত্র লোকদেখানো মতবিনিময় সভা যথেষ্ট নয়। প্রকৃত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা, এনজিও, আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। স্থানীয়দের সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে হবে।
জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় সফল হতে হলে শুধু প্রযুক্তি বা অর্থের ওপর নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। স্থানীয়দের মতামত এবং অংশগ্রহণও অপরিহার্য। স্থানীয়দের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। কারণ তাদের অংশগ্রহণে প্রকল্পগুলো অধিক কার্যকর ও সফল হয়। সবার অংশগ্রহণে একটি জলবায়ু সহনশীল বাংলাদেশ গঠন সম্ভব। এতে সবাইকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে।
লেখক: সাংবাদিক
সারাবাংলা/এএসজি