শিক্ষকের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা
৫ মে ২০২৫ ১৭:৫৭ | আপডেট: ৭ মে ২০২৫ ১৮:০০
এটা সর্বজন বিদিত ও স্বীকৃত যে, ‘শিক্ষা’ জাতির মেরুদন্ড। যদি তাই হয় তবে, ‘শিক্ষক’ হলো সেই মেরুদন্ডের মজ্জা। কোনো জাতির অস্তিত্ব, সুরক্ষা, অগ্রায়ন ও উন্নয়নের নেপথ্যে শিক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে যার নেপথ্য সুশীলব একমাত্র শিক্ষক। এ বাস্তবতার নিরিখে শিক্ষক একটি জাতি ও রাস্ট্রের জন্য অপরিহার্যভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, একটি রাস্ট্রের তাবৎ স্বীকৃত পেশার জন্মদাতা শিক্ষক। সে হিসাবে শিক্ষকতা হলো উৎকৃষ্টতম তথা শ্রেষ্ঠতম পেশা। শিক্ষকের মহতী গুরুত্ব বিবেচনায় যুগে যুগে শিক্ষকের প্রতি ভক্তি , শ্রদ্ধা ও সন্মানের বহু হৃদয়গ্রাহী কাহিনী বা ইতিহাস বিশ্বব্যাপী বিবৃত আছে যা এই স্বল্প পরিসরে বলে শেষ করা যাবেনা; এগুলোতে প্রতীয়মান হয় যে, একটি পরিশীলিত জাতি ও রাস্ট্র গঠনে শিক্ষকের ভুমিকা অনস্বীকার্য।
উল্লেখ্য, এ হেন গুরুত্ব বিবেচনায় শিক্ষকের মর্যাদা ও অধিকার বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখতে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা-ইউনেস্কো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা- আইএলও এর যৌথ উদ্যোগে ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে একটি সনদ প্রণীত ও গৃহীত হয়। প্রণীত সনদ অনুস্মরণ ও যথাযথ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালে ‘এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি আন্তর্জাতিক শিক্ষক সংগঠন গঠিত হয়। ১৬৭টি দেশের ২১০টি জাতীয় সংগঠনের প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ শিক্ষক সদস্যের সমন্বয়ে ১৯৯৩ সালে এ সংগঠনটি গঠিত হয়। উক্ত সংগঠনের সচেষ্টায় ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর ২৬ তম অধিবেশনে ইউনেস্কোর তদানীন্তন মহাপরিচালক ড. ফ্রেডারিক এম মেয়র ৫ অক্টোবর ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালনের ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন। শিক্ষকের মর্যাদা অনুধাবন পূর্বক শিক্ষকের গুরুত্ব ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেতনতা সৃষ্টিতে পরবর্তীতে প্রতিবছরের ৫ অক্টোবর এই দিবসটি বিশ্বব্যাপী যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে। ২০১৩ সালে ভার্কি ফাউন্ডেশন নামে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের ওপর একটি গবেষণা চালিয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, যে সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা বেশী সে সমাজে শিক্ষার্থীরা ভালো শিক্ষা পায়। গবেষণালব্ধ তথ্যানুযায়ী শিক্ষকরা সবচেয়ে বেশী মর্যাদা পান বিশ্বের এমন শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যে রয়েছে: ১. চীন, ২. মালয়েশিয়া, ৩. তাইওয়ান, ৪. রাশিয়া, ৫. ইন্দোনেশিয়া, ৬. দক্ষিণ কোরিয়া, ৭. তুরস্ক, ৮. ভারত, ৯. নিউজিল্যান্ড, ১০. সিঙ্গাপুর। প্রদত্ত প্রতিবেদনে স্পষ্টত যে, শীর্ষ দেশগুলোর সাতটিই আমাদের এশিয়ার। শুধু তাই-ই নয়, শিক্ষকদের সর্বাধিক মর্যাদা প্রদানকারী দেশেরও তালিকায় রয়েছে এশিয়ার চীন, মালয়েশিয়া ও তাইওয়ান যা ‘ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ইকোনোমিক এন্ড সোশ্যাল রিসার্চ’ নামক ব্রিটেন ভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার তথ্যে উঠে এসেছে। সংস্থাটি ৩৫টি দেশের ৩৫,০০০ মানুষের ওপর গবেষণা চালিয়ে ‘শিক্ষকের মর্যাদা সূচক’ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। এক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষতম স্থানে রেয়েছে চীন যার ৮১ শতাংশ শিক্ষার্থী উপলব্ধি করে (যেখানে আন্তর্জাতিক গড় ৩৫ শতাংশ) যে, শিক্ষকদের সন্মান করতে হবে ও মর্যাদা দিতে হবে। লক্ষ্যণীয়, আমাদের আশেপাশের রাস্ট্রগুলো, এমনকি, নিকটতম প্রতিবেশী ভারতও যখন শিক্ষকের মর্যাদা প্রদানে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষে অবস্থান করছে তখন বাংলাদেশে শিক্ষকসমাজের কি হাল(!) তা স্বভাবতই কৌতুহল জাগায়।
বলাবাহুল্য, কোনো পেশাজীবি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মর্যাদা নির্ণিত হয় এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক মানদন্ডের ওপর। ইউনেস্কোর মতে, যে কোনো দেশের শিক্ষা খাতে তার জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ বা জিডিপি’র ৬ শতাংশ বরাদ্দ থাকা উচিত। অথচ, এর বিপরীতে আমাদের দেশে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির ২ শতাংশেরও কম। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ১৮৯টি সদস্য দেশের মধ্যে অর্থনীতির সক্ষমতার তুলনায় শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয় যে ১০টি দেশ, বাংলাদেশ তার একটি। দক্ষিণ এশিয়ায় জিডিপির বিপরীতে শিক্ষা খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে ভুটান। দেশটিতে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ মোট জিডিপির ৮ দশমিক ১ শতাংশ। এছাড়া এ বরাদ্দের হার ভারত ও মালদ্বীপে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ এবং আফগানিস্তানে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শিক্ষা খাতের বিভিন্ন দায় মিটিয়ে উল্লেখিত বরাদ্দের কতটুকুইবা শিক্ষকদের জীবন মানে ব্যয় হয় তা অবস্থাদৃষ্টে সহজেই অনুমেয়।এ চিত্রটা মোটেও সুখকর নয়।কেননা, এদেশে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার মতো খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্তরের প্রায় ৯৭ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই এখনো বেসরকারি (এমপিও) যেখানে প্রায় ছয়লক্ষ জনবলের বেতনভাতাদি রাস্ট্রকর্তৃক প্রদেয় অনুদান নির্ভর এবং যা বাজার অর্থনীতির সাথে যথেষ্ট অসামঞ্জস্যপূর্ণ। উদাহরণ স্বরূপ, এখানে বিদ্যমান জনবলের প্রত্যেকের চিকিৎসা ও বাসস্থান এর মতো দুটি মৌলিক চাহিদার প্রদেয় ভাতা যথাক্রমে মাত্র ৫০০ টাকা ও ১০০০ টাকা যা শুধু বিষ্ময়করই নয় লজ্জাকরও বটে। এ হেন বাস্তবতায় এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, দেশের শিক্ষাখাতের সবচেয়ে বড় অংশ- এই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীদের জীবন যথেষ্ট অবহেলিত। এ ক্ষেত্রে দেশের সরকার ও রাজনীতি যথেষ্ট উদাসীন তথা গুরুত্বহীন মর্মে অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয়।
প্রসঙ্গত, আমাদেরই পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন এন্ট্রিলেভেল সহকারী শিক্ষক প্রারম্ভিক পর্যায়ে মাসিক বেতন পান সর্বসাকুলয়ে প্রায় ১৮ হাজার ৫০০ টাকা যা ভারতে ৩৫ হাজার টাকা, পাকিস্তানে ৩০ হাজার টাকা, শ্রীলঙ্কায় ২৭ হাজার টাকা, নেপালে ৩৫ হাজার টাকা, ভুটানে ৩৩ হাজার টাকা ও মালদ্বীপে ৬৩ হাজার টাকা। আবার, মাধ্যমিকে বাংলাদেশের এমপিওভুক্ত একজন এন্ট্রিলেভেল সহকারী শিক্ষক বেতন পান ১২ হাজার ৫০০ টাকা; সাথে মাত্র ১০০০টাকা ঘর ভাড়া ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা। অর্থাৎ, শুরুতেই সর্বসাকুল্যে পান ১৪০০০ টাকা; অথচ যেখানে ভারতে ৪০ হাজার টাকা, পাকিস্তানে ৩০ হাজার টাকা, শ্রীলঙ্কায় ৩২ হাজার টাকা, নেপালে ৩৫ হাজার টাকা, ভুটানে ৩৯ হাজার টাকা ও মালদ্বীপে ৯০ হাজার টাকা। অপরদিকে, প্রায় সাত হাজার নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের কলেজের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষক এবং স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রায় ২০ হাজার শিক্ষক সরকার থেকে বেতন তো দূরের কথা নুন্যতম কোনো সুবিধাও পান না। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিমাসে যা দেওয়া হয় তাতে হাতখরচও মেটেনা যা এখানে উল্লেখ করাই লজ্জাকর। অনেক প্রতিষ্ঠানে তারা বিনাপয়সায়ও শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। বেতন তুলনা ও ক্যারিয়ার সংস্থান বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘স্যালারি এক্সপ্লোরার’-এর সমীক্ষামতে , ভারতে একজন সহকারী অধ্যাপকের মূল বেতন ৪৭ হাজার ৩০৪ রুপি, সিনিয়র স্কেল প্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপকের ৫৬ হাজার ৪৮০ রুপি, সহযোগী অধ্যাপকের এক লাখ সাত হাজার ৭৪৮ রুপি এবং অধ্যাপকদের এক লাখ ১৬ হাজার ৭০ রুপি। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন আরো বেশি।অথচ, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা তুলনামূলক বেশ কম।
উল্লেখ্য, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তির অর্থনৈতিক মর্যাদার সাথে সামাজিক মর্যাদা জড়িত। ফলে, ব্যক্তির অর্থনৈতিক অবস্থা ব্যক্তির সামাজিক অবস্থানকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশ এর বাইরে নয়। উদাহরণস্বরূপ,পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার কারণে নিউইয়র্ক সিটির সমাজ মূলত অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর মানদণ্ড নির্ধারণ করে। এখানে দেখা হয় কোন শিক্ষক কতটুকু বেতন পান। শিক্ষকের মানদণ্ড অর্থের মাপকাঠিতে নির্ণীত হয়।পাশাপাশি, শিক্ষকতার সামাজিক সন্মান তো আছেই। অপরদিকে, চীনে একজন শিক্ষক কম বেতন পেলেও শিক্ষককে সম্মানের চোখে দেখা হয়।
উল্লেখিত পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, নিকটবর্তী দেশের তুলনায়ও আমাদের দেশে শিক্ষকদের অর্থনৈতিক মর্যাদা তো নাই-ই, সামাজিক মর্যাদাও নাই। উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের দেশে নবম গ্রেডের একজন সরকারী চাকুরীজীবি (প্রারম্ভিক পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা) সামাজিক ভাবে যে মূল্যায়ন পান, একই গ্রেডের একজন সরকারী শিক্ষক অনেক ক্ষেত্রে সেটা পান না। আর সেই কর্মকর্তা যদি নবম গ্রেডের প্রশাসন কিংবা পুলিশ ক্যাডারের হন তাহলে তো সেই শিক্ষকের সাথে তার তুলনা কল্পনাতীত। কারণ সমাজই তখন সেই ক্যাডারকে ব্রাহ্মণ বনে দেয়; এমনকি তারা তখন নিজেকে রাবণ বোধ করতেও দ্বিধা করেন না (ব্যতিক্রম বাদে)। নেপথ্য কারণ- তারা ক্ষমতাশ্রয়ী সেবক নয়,বরং ক্ষমতাশ্রয়ী শাসক। পাশাপাশি, এদের অনেকেরই ক্ষেত্রে অবৈধ আয়ে সৃষ্ট অহং প্রসূত ‘ঔদ্ধত্য’ তো আছেই। আর, এ তুলনার ক্ষেত্রে যদি নবম গ্রেডের বেসরকারি শিক্ষক থাকেন, তবে তো কথাই নাই!তিক্ত হলেও সত্য, আমাদের সমাজে চতুর্থ শ্রেনীর একজন কর্মচারী যদি সরকারি হয়ে থাকেন তবে তিনিও একজন নবম গ্রেডের বেসরকারি শিক্ষক কে সাধারণত মূল্যায়ন করতে চান না। কারণ তিনি নিজেকে ‘সরকারি’ বোধ করেন। এমনকি, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, পরিদপ্তর ও অধিদপ্তর গুলোতেও বেসরকারি শিক্ষকরা অপেক্ষাকৃত নিম্নগ্রেডের এমনকি চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারীদের দ্বারাও যথেষ্ট নাজেহালের শিকার হন যার ভুরিভুরি উদাহরণ আছে। এর প্রধান কারণ- অর্থনৈতিক বৈষম্যে সৃষ্ট সামাজিক বৈষম্য।লোক লজ্জার ভয়ে ও পেশাগত ইজ্জত রক্ষার তাগিদে শিক্ষকগণ তা প্রকাশ করেন না।
স্মর্তব্য, অর্থনৈতিক অবহেলার পাশাপাশি সামাজিক হেনস্তার বহু অপ্রীতিকর নজির এ সমাজে আছে। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ১০ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের তদানীন্তন স্থানীয় সাংসদ সেলিম ওসমানের নির্দেশে শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে উঠবস করানো হয়। এমনকি সেই শিক্ষক কে কানে থাপ্পর মেরে কান ফাটিয়ে রক্তাক্ত করারও নির্মম অভিযোগ ওঠে। ২০২২ সালে নড়াইলে পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতেই শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরিয়ে ক্যাম্পাসে শোডাউন দেওয়ানো হয়। এছাড়া, ২০২২ সালে মুন্সিগঞ্জে শিক্ষক- হৃদয় চন্দ্র মন্ডল ও নওগাঁয় আমোদিনী পালকে চরম হেনস্তা করা হয়। এ হেন প্রতিটি ঘটনা-ই দেশব্যাপি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এছাড়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ দ্বারা শিক্ষক হেনস্তা হওয়ার অসংখ্য অপ্রীতিকর ঘটনা আছে যার অনেকটাই অপ্রকাশিত থেকে যায়।
সর্বশেষ, জুলাই অভ্যুত্থানের প্রভাব খাটিয়ে দেশের একমাত্র পেশাজীবি গোষ্ঠী হিসাবে শিক্ষকরা একশ্রেণির সুযোগসন্ধানী স্বার্থান্বেষী মহল দ্বারা দেশব্যাপী নজিরবিহীন হেনস্তার শিকার হয়েছেন। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে একাধিকবার হুঁশিয়ারী ঘোষণার পরও তা থেমে নেই যা সাধারণ মানুষকে হতভম্ব করে তুলেছে! এ হেন ঘটনায় সৃষ্ট মানসিক যাতনায় ইতোমধ্যে একাধিক শিক্ষকের করুণ মৃত্যুও ঘটেছে যা হৃদয় বিদারক বটে। জার্মান ভিত্তিক বাংলা সংবাদ সংস্থা ‘ডয়েচে ভেলে’ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রের বরাতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে; এতে বলা হয়েছে, ৫ আগষ্টের পর সারাদেশে মব সৃষ্টির মাধ্যমে ২০০০ শিক্ষক কে পদত্যাগে বাধ্য করানো হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতেই দুইশতাধিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে কলেজ, স্কুল এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও এই ‘মব’ থেকে রেহাই পাননি। মারধর এবং মামলা থেকেও তারা রোহাই পাননি। তারা বেতনও পাচ্ছেন না। ইতোমধ্যে, ৮০০ জন শিক্ষক আদালতের স্মরণাপন্ন হয়েছেন। প্রথম দিকে ছাত্রদের দ্বারা এটা সংঘটিত হলেও পরে এর সঙ্গে নানান রাজনৈতিক ও স্বার্থান্বেষীমহলও প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়।’ অনেকে মবের ভয়ে প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছেন না। উল্লেখ্য, বর্তমানে পরিবার পরিজন নিয়ে এ সকল শিক্ষকরা খুবই মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এমতাবস্থায়, জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করানো ও হেনস্তার শিকার শিক্ষকদের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ইতোমধ্যে শিক্ষামন্ত্রণালয় দেশব্যাপী বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকগণকে নির্দেশনা প্রদান করেছেন। সরকারের এ হেন ইতিবাচক পদক্ষেপে যখন শিক্ষক সমাজে কিছুটা হলেও স্বস্তির হাওয়া বইছে ঠিক তখনই চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারীর হাজী তোবারক আলী চৌধুরী (টিএসি) উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আচার্যকে ১৬ এপ্রিল ২০২৫ এ মবের মাধ্যমে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই নেওয়ার অভিযোগ ওঠে যা শিক্ষক সমাজকে পুনরায় ব্যথিত করে তোলে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার নরোত্তমপুর ইউনিয়ন উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইউনুস নবী থেকে ২৪ অক্টোবর ২০২৪ এ জোর করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নেওয়ার পর ২৩ এপ্রিল ২০২৫ এ আবেগের টানে বিদ্যালয়ে গেলে তাকে মারধর করা হয়।এখানে উল্লেখ থাকে যে, সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনার কারণে তখন তার পদত্যাগপত্রটি গৃহীত হয়নি। এছাড়াও, ঐ পদত্যাগপত্রের কার্যকারিতার ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা বলবৎ আছে। এ সময় তার পরনের জামা-কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয় যা মিডিয়ায় ভাইরাল হলে শিক্ষক সমাজে গভীর বিষন্নতা নেমে আসে।উক্ত বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি ও তার সহযোগীদের হাতে তিনি এই নির্মমতার শিকার হন।
উল্লেখ্য, পাঁচ আগষ্ট পরবর্তী সংঘটিত এসকল নজিরবিহীন শিক্ষক হেনস্তায় শিক্ষক সমাজ একটি গভীর ট্রমার মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হচ্ছে যা শিক্ষার জন্য কখনোই শুভকর নয়। রাস্ট্র ও সরকারকে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ। আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষকতা শতভাগই একটি মেধাভিত্তিক (Meritorius) ও বুদ্ধিবৃত্তিক (Intellectual) পেশা। এটি একটি স্নায়বিক শ্রমের পেশা। শিক্ষক সমাজ এমনিতেই অর্থনৈতিক বৈষম্যে জীবনভোর জর্জরিত। তা সত্তেও নীতি-নৈতিকতা’র দায় বোধ থেকে এই বৈষম্যিক অবহেলা কে তারা শিক্ষকতার প্রকৃতি প্রসূত ঔদার্য থেকে মেনে নেন। কিন্তু যখনই তারা একটু অধিকারের কথা বলেন, তখনই তাদেরকে ন্যায়নীতির চিরন্তনী বাণী’র প্রশংসনীয় হিমবাহে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। আর যখন তারা ন্যায্য অধিকারের সচেতন দাবীতে বাধ্য হয়ে রাজপথে জীবনবাজির অনশন বেছে নেন, তখন শান্তিপূর্ণ প্রদশর্ন সত্ত্বেও তাদেরকে অবলা প্রাণীর মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জলকামান,কাঁদানে গ্যাস, লাঠি-বুট এর নিঠুর আঘাতে ক্ষত -বিক্ষত ও জীর্ণবিদীর্ণ হতে হয়; এমনকি অনশনে নিভৃতে প্রাণও দিতে হয় যার যবনিকাপাত ঘটে এক নিষ্ফল প্রাপ্তির বেদনাদায়ক গভীর হতাশার মধ্য দিয়ে। তার ওপর আবার মব ভায়োলেন্স’র নিঠুর আঘাতে- কষাঘাতে সারাজীবনের সঞ্চিত মর্যাদা ও জীবিকার নির্মম অপমৃত্যু! এ যেন মরার ওপর খারার ঘা। এই হলো অজস্র- প্রাণ, সম্ভ্রম ও রক্তের প্লাবনে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজের হৃদয়বিদারক ট্রাজেডি যা সমগ্র বিশ্বে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবেনা। বিষ্মিত বিষয় হলো, বিরাজমান পরিস্থিতি উত্তরণে রাজনৈতিকসমাজ এমনকি সুশীলসমাজকেও অনেক ক্ষেত্রে নীরব থাকতে দেখা যায় গভীর বেদনার বটে! সমাজে পরিশীলিত চেতনার এ কেমন অবক্ষয়! ভাবতেই উদ্বেগে শিউরে উঠার উপক্রম জাগে! পরিশুদ্ধ জাতি ও দেশ গড়নে অর্থনৈতিক অবহেলা ও সামাজিক হেনস্তার কবল থেকে আমাদের শিক্ষক সমাজকে দ্রুতই মুক্ত করে ও সুরক্ষা দিয়ে জাতি ও দেশকে কলংকমুক্ত করতে হবে; তা না হলে এর দীর্ঘমেয়াদী কুফল জাতি ও দেশকে অন্ধকার থেকে বিপন্নে ঠেলে দিতে পারে!
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এএসজি
কাজী মাসুদুর রহমান মুক্তমত শিক্ষকের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা