মুসলিম বিশ্বের দুর্বিষহ অবস্থা ও মুক্তির প্রত্যাশা
৮ মে ২০২৫ ১৪:১৬ | আপডেট: ৮ মে ২০২৫ ১৮:১৯
সমুদ্রের অতল গহ্বরে যেমন চাপা পড়ে যায় মুক্তার ঝিলিক, ঠিক তেমনি আজ বিশ্বের বুকে চাপা পড়ে আছে এক জাতির জ্যোতি—যারা একদিন আলোকবর্তিকা হাতে এগিয়ে দিয়েছিল সভ্যতার পথ। আজ সেই মুসলিম জাতি ছিন্নভিন্ন, অস্থির, দুর্বল ও বিভ্রান্ত। ইতিহাসের স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় পেছনে ফেলে তারা যেন চলছে এক অনির্দিষ্ট পথে, যেখানে গন্তব্য নেই, নেই দিকনির্দেশনা। আশ্চর্যজনকভাবে, এই ব্যস্ততা অগ্রগতির নয়—বরং এটি একটি দুর্বিষহ বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করে, যেখানে ক্লান্তি আছে, হতাশা আছে, আর রয়েছে মুক্তির জন্য এক অস্পষ্ট প্রার্থনা।
মুসলিম বিশ্বের বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাকালে চোখে পড়ে এমন এক চিত্র, যেখানে একদিকে রক্তাক্ত যুদ্ধের শিকার শিশু, অন্যদিকে বিলাসিতায় মোড়া ক্ষমতালোভী নেতৃত্ব; একদিকে শরণার্থী শিবিরের দীর্ঘশ্বাস, অন্যদিকে উচ্চতম অট্টালিকার নীচে গড়ে ওঠা অবহেলিত সমাজ। এই বৈপরীত্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ব্যর্থতার ক্ষতচিহ্ন—যা একদিকে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, অন্যদিকে বহিরাগত শক্তির নিরন্তর চাপের ফলাফল।
একদিন মুসলিম বিশ্ব ছিল জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন ও আত্মশক্তির কেন্দ্রস্থল। বাগদাদের আলো, কোর্দোবার পাঠশালা কিংবা সমরখন্দের জ্যোতির্বিদ—সবই ছিল প্রগতির প্রতীক। কিন্তু আজ সেই ঐতিহ্য শুধু পাঠ্যবইয়ের পাতায় অথবা বক্তৃতার অলংকারে সীমাবদ্ধ। বাস্তবতায় মুসলিম সমাজ আজও পিছিয়ে আছে তথ্যপ্রযুক্তি, গবেষণা, শিক্ষা ও নৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে। কী এমন ঘটল, যে জাতি আল্লাহর পক্ষ থেকে পেয়েছিল সর্বশেষ ও পরিপূর্ণ জীবনবিধান, সেই জাতিই আজ সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত, বিভ্রান্ত ও দুর্বল?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে অভ্যন্তরীণ কাঠামোর দিকে। প্রথমত, মুসলিম বিশ্ব আজ একতা হারিয়েছে। জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, গোষ্ঠীগত বিভাজন এবং রাজনৈতিক স্বার্থপরতা জাতিকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। উম্মাহর ধারণা—যেখানে সকল মুসলমান ছিল একটি দেহের মতো—আজ তা শুধু তাত্ত্বিক; বাস্তবতায় তা মৃতপ্রায়।
দ্বিতীয়ত, নেতৃত্ব সংকট। বহু মুসলিম রাষ্ট্রে এমন নেতৃত্ব বিরাজমান যারা জনগণের নয়, বরং ক্ষমতা রক্ষার রাজনীতি করে। এসব শাসক নিজেদের সিংহাসন রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক কূটচালে জড়িত হয়ে পড়েছে, যার ফলে জাতির ভবিষ্যৎ প্রতিনিয়ত জলাঞ্জলি দিচ্ছে। তারা শিক্ষার বদলে জ্ঞানের পথ রুদ্ধ করে রেখেছে, ধর্মের বদলে উগ্রতা ছড়াচ্ছে, আর উন্নয়নের পরিবর্তে তৈরি করছে এক নিষ্প্রাণ রাষ্ট্র কাঠামো।
তৃতীয়ত, আত্মপরিচয়ের সংকট। মুসলমানেরা আজ তাদের চিন্তা, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসকে উপস্থাপন করতে ভয় পায়। পশ্চিমা মডেলকে অন্ধভাবে অনুসরণ করতে গিয়ে তারা ভুলে গেছে যে ইসলাম নিজেই একটি পরিপূর্ণ সভ্যতা, যেখানে মানবতা, জ্ঞান, সৌন্দর্য ও ভারসাম্য মিলেমিশে এক অসাধারণ রূপ ধারণ করেছে। আত্মসম্মান ও আত্মবিশ্বাস হারিয়ে গেলে কোনো জাতিই উন্নত হতে পারে না—মুসলিম বিশ্বও তার ব্যতিক্রম নয়।
এই দুর্বিষহ বাস্তবতার মধ্যেও আমরা দেখি মুক্তির আশাবাদ। এই আশাটি একদিন ছিল রাসুল (সা.)-এর সাহাবিদের হৃদয়ে, যারা বদরের ময়দানে সংখ্যা ও অস্ত্রে কম থাকলেও ঈমানের শক্তিতে বিজয় লাভ করেছিল। আজও সেই ঈমান, সেই আত্মশক্তি মুসলিম জাতির রক্তে বহমান—শুধু তাকে জাগিয়ে তুলতে হবে।
মুক্তি আসবে যখন আমরা নিজস্ব ব্যর্থতা চিনে নেব, আত্মসমালোচনার সাহস রাখব। প্রয়োজন এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে ইসলাম ও আধুনিকতা হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাবে। যেখানে তৈরি হবে এমন প্রজন্ম, যারা চিন্তাশীল, উদার, বিজ্ঞানমনস্ক এবং আধ্যাত্মিকভাবে সমৃদ্ধ।
নেতৃত্বেও পরিবর্তন আনতে হবে। মুসলিম বিশ্বকে প্রয়োজন এমন নেতার, যিনি কেবল একজন শাসক হবেন না, বরং হবেন এক দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন পথপ্রদর্শক। যিনি জাতিকে বিভক্তির রাজনীতি নয়, ঐক্যের ভিত্তিতে গড়ে তুলবেন। একই সঙ্গে নাগরিকদের মধ্যে সৃষ্টি করতে হবে সচেতনতা, যাতে তারা নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে পারে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে।
অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হবে। মুসলিম বিশ্বে অঢেল সম্পদ আছে—তেল, গ্যাস, খনিজ, কৃষি, জনশক্তি—সবই আছে, শুধু নেই একটি ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। যদি এই সম্পদগুলো ন্যায়সঙ্গতভাবে ব্যবহৃত হয়, তবে দারিদ্র্য, নির্যাতন ও নির্ভরতা অনেকাংশে দূর হবে।
সবশেষে, মুসলিম জাতির উচিত তাদের আত্মপরিচয় পুনরুদ্ধার করা। ইসলাম কোনো সঙ্কীর্ণ বিশ্বাস নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা—যেখানে রয়েছে আলোকিত পথচলা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, মানবতার প্রতি ভালোবাসা এবং আত্মশক্তির উন্নয়ন। এই মূল মন্ত্রগুলো পুনরায় হৃদয়ে ধারণ করলেই সম্ভব হবে দুর্বিষহ ব্যস্ততা থেকে মুক্তির দিকে যাত্রা।
আজ এই অস্থিরতার মাঝেও বাতাসে ভেসে বেড়ায় একটি প্রশ্ন—‘কে ফিরিয়ে আনবে সেই গৌরব?’ উত্তর একটাই—নিজেদের জাগিয়ে তুললে, আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলে, আল্লাহর নির্দেশে ও রাসুলের আদর্শে যদি আমরা ফিরে আসি, তবে ইতিহাস আবারও বদলাবে। আর সেই পরিবর্তন সূচিত হবে অন্তর থেকে, বিশ্বাস থেকে, এবং সঠিক কর্মপন্থা থেকে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ
সারাবাংলা/এএসজি