মা। ছোট্ট একটি শব্দ, কিন্তু এর মধ্যে লুকিয়ে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিশাল, নির্ভরযোগ্য ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসার অনুভব। মা মানে আশ্রয়, মা মানে আস্থা, মা মানে নিঃশর্ত ভালোবাসার প্রতীক।
বিশ্বের অনেক দেশেই মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার পালিত হয় মা দিবস। আমাদের দেশেও এখন দিনটি বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। ছোট-বড় সবাই ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামসহ নানা মাধ্যমে মাকে নিয়ে ছবি পোস্ট করে, ভালোবাসার কথা লিখে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে উঠবে হাজারো পোস্ট, ছবি, আবেগঘন লেখা ‘তুমি আমার পৃথিবী’, ‘তুমি ছাড়া আমি কিছুই না’, ‘মা, তোমায় ভালোবাসি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। নামী-দামী তারকা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, সবাই মাকে নিয়ে ভালোবাসার কথা বলবে। কেউ কেউ হয়তো স্মৃতিচারণ করবে পরলোকগত মাকে নিয়ে।
কিন্তু এই ভালোলাগার ভিড়ে একটি প্রশ্ন বেদনাবোধ ছড়িয়ে দেয়, এত ভালোবাসা যদি বাস্তবেও থাকত, তবে কেন আজও এত মা বৃদ্ধাশ্রমে একাকী দিন গুনছেন? কেন এত মা কেবল ফোনের অপেক্ষায়, একটিবার সন্তানের কণ্ঠ শুনবেন বলে?
আজ মা দিবস আমাদের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা তুলে ধরে ভালোবাসা কি কেবল বিশেষ দিনে পোস্ট দেওয়ার জন্য? না কি ভালোবাসা হচ্ছে মায়ের পাশে থাকা, তার প্রয়োজনের সময়ে পাশে দাঁড়ানো, তার মনের কথাগুলো শোনার চেষ্টাটুকু করা?
বাংলাদেশের বিভিন্ন বৃদ্ধাশ্রমে গেলে দেখা যায়, অনেক মায়ের চোখে এক ধরনের শূন্যতা। তাদের সন্তানেরা বিদেশে বা রাজধানীর অভিজাত এলাকায়, কিংবা ব্যস্ত কর্মজীবনে ডুবে, সময় হয় না মায়ের সঙ্গে দেখা করার। অনেকে বছরের পর বছর মায়ের খোঁজ নেয় না, এমনকি ফোনও করে না। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই সন্তানেরাই মাকে নিয়ে কবিতা লেখে, ভিডিও বানায়, ভালোবাসার মহোৎসব করে!
সোশ্যাল মিডিয়ায় যত আবেগই থাক, বাস্তবে যদি মা একা থাকেন তাহলে আমাদের ভাবতে হবে, আমরা আসলে কী করছি?
এখনো আমাদের গ্রামাঞ্চলে দেখা যায়, মা আছেন গাঁয়ের এক কোণে। আর ছেলে ঢাকায়, ভালো চাকরি করছে। মাসে একবার টাকা পাঠায় ঠিকই, কিন্তু মায়ের মুখ দেখা হয় না ঈদেও। মায়ের অসুখবিসুখ, একাকিত্ব, মানসিক চাহিদা সবই উপেক্ষিত। অথচ সেই সন্তানই মা দিবসে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখে ‘তুমি আমার পৃথিবী!’
আর শহরে? অনেক জায়গায় বৃদ্ধা মাকে ছেলের পরিবার যেন বোঝা মনে করে। সন্তানেরা আধুনিক জীবনের ছুটে চলায় মাকে জায়গা দিতে পারে না নিজের সংসারে। তাই নিরুপায় হয়ে মা বৃদ্ধাশ্রমে যান।
আমরা এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে সম্পর্কগুলো যেন ধীরে ধীরে দূরত্বে চলে যাচ্ছে। মানুষ ব্যস্ত, জীবনের গতি অনেক দ্রুত। কিন্তু এই ব্যস্ততায় যারা সবচেয়ে অবহেলিত হচ্ছেন, তাদের একজন হলো মা।
একসময় যে মা আমাদের হাত ধরে হাঁটতে শিখিয়েছেন, না খেয়ে আমাদের খাইয়েছেন, আমাদের জন্য রাত জেগে কেঁদেছেন, সেই মায়ের জায়গা যেন এখন অনেক পিছিয়ে গেছে।
তবু মা সবসময় মা-ই থাকেন। সন্তানকে দোষ দেন না। কোনো অভিযোগ রাখেন না। শুধু অপেক্ষায় থাকেন, একদিন হয়তো সন্তান এসে বলবে, ‘মা, চলো, বাড়ি চলো!’
মা দিবস তাই কেবল একটা দিবস নয়, এটা আমাদের আত্মসমালোচনার দিন। আমরা কি সত্যিই মাকে ভালোবাসি, না কি সমাজের চোখে ভালো সন্তান দেখানোর চেষ্টা করি?
আমরা কি বুঝি, এই মা-ই আমাদের জন্য জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ? তার প্রার্থনা, তার চোখের জল, তার নিঃশব্দ আশীর্বাদ আমাদের জীবনের অনেক কঠিন মুহূর্তে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়।
অনেক মা আছেন, যাদের সন্তান সফল, স্বনির্ভর। কিন্তু তারা হয়তো সেই মায়ের মুখটিও মাসের পর মাস দেখেন না। সেই মা টিভিতে সন্তানকে দেখে, গর্ব করেন, আবার নিঃশব্দে চোখ মুছেন।
আমরা চাইলে প্রতিদিন মা দিবস করতে পারি কেবল একটু যত্ন দিয়ে, একটু কথা বলে, একটু সময় দিয়ে।
মা দিবসে তাই আর ফুল কিংবা কার্ড নয়, এবার সময় দিই মাকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট নয়, এবার ভালোবাসা দিই বাস্তবে। কারণ একটাই, ‘মা আছেন বলেই আজও পৃথিবীটা এতটা মমতাময়।’
লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়