একটা সময় ছিল, যখন বিয়ে মানেই ছিল আজীবন একসাথে থাকার প্রতিশ্রুতি। দুঃখ–সুখ ভাগাভাগি করে জীবন পার করার সংকল্প। এখন সময় বদলেছে। বদলেছে সম্পর্কের ভাষা, বদলেছে সহনশীলতার মানদণ্ড। বদলেছে সংসার টিকিয়ে রাখার মানসিকতা। বিয়ের কয়েক মাসের মাথায়ই তালাক কিংবা আলাদা হয়ে যাওয়ার ঘটনা এখন ‘অস্বাভাবিক’ কিছু নয়।
পরিসংখ্যান বলে, বিগত কয়েক বছরে দেশে ডিভোর্স বা বিবাহবিচ্ছেদের হার লাফিয়ে বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) হিসেব অনুযায়ী শুধু ঢাকা শহরেই প্রতি মাসে গড়ে ১,২০০ থেকে ১,৪০০ ডিভোর্সের আবেদন জমা পড়ে। ২০২২ সালে দেশের বিবাহবিচ্ছেদের হার ছিল প্রতি ১০,০০০ জনে ১৪ জন; যা ২০১৫ সালে ছিল মাত্র ৩ জন। এর মানে দাঁড়ায়—গত এক দশকে ডিভোর্সের হার বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ। এই ভয়াবহ চিত্র কি কেবল একটি অশুভ ট্রেন্ড? নাকি এর পেছনে রয়েছে আমাদের সমাজ কাঠামোর অন্তর্নিহিত কিছু ফাঁকফোকর? সংসার ভাঙনের দায় কি শুধুই দু’জন মানুষকে দেওয়া যাবে? নাকি এর পর্দার পেছনে থেকে চালনা করে কিছু অভিভাবক, আত্মীয় বা পারিবারিক রাজনীতি?
প্রশ্ন অনেক। আর সেসব প্রশ্নের কেন্দ্রে উঠে আসে একটি পরিচিত মুখ—মেয়ের মা।
হ্যাঁ, সবাই নয়, কিন্তু বহু সংসার ভাঙনের নেপথ্যে থাকেন মেয়ের মা। মেয়েকে সঠিক শিক্ষা না দিয়ে, তাকে সংসারের বাস্তবতা বুঝতে না দিয়ে, বরং ‘তুমি কারো চেয়ে কম নও’, ‘তোমার ইচ্ছে না হলে কোনো কিছু করো না’, ‘ওদের তুমি দরকারি না’—এই কথাগুলো যদি বারবার বলা হয়, তাহলে মেয়েটি একটি প্রতিযোগিতার ময়দানে নেমে পড়ে, যেখানে স্বামী, শ্বশুরবাড়ি সবাই তার প্রতিপক্ষ।
বেশিরভাগ মা-বাবা মেয়েকে শেখান, ‘সংসারে মানিয়ে চলতে হয়।’ কিন্তু একশ্রেণির মা মেয়েকে শেখান, ‘মানিয়ে নিতে নেই, জবাব দিতে হয়।’ ফলাফল- একটা ছোট্ট ঝগড়া গিয়ে ঠেকে বিশাল মনোমালিন্যে। একসময় এমন হয়, দুজনেই ভাবতে শুরু করে—এই সম্পর্কে লাভ কী?
দুঃখজনক হলেও সত্য—আজকাল মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি যেতে ভয় পায় না, বরং মা-বাবার কথার বাইরে চলতে ভয় পায়। বিয়ের পরেও প্রতিটি সিদ্ধান্তে যখন মা নেতৃত্ব দেন, তখন মেয়ের স্বামী ‘অপ্রাসঙ্গিক’ হয়ে পড়ে। এতে যে শুধু স্বামী অসন্তুষ্ট হন, তা নয়—মেয়ের মনেও জন্ম নেয় দ্বিধা, আত্মপরিচয়ের সংকট।
অন্যদিকে ছেলের বোনদেরও দোষ কম নয়। ভাইয়ের বিয়ে হতেই অনেকেই ভাবেন—’নতুন বউ এলে তার জায়গা কমে যাবে’। শ্বশুরবাড়িতে কর্তৃত্ব হারানোর ভয়ে অনেকে শুরু করেন মানসিক নির্যাতন, খোঁচা, অবজ্ঞা। এমনকি মা-বাবার সামনেই ভাই-বউয়ের মধ্যে বিরোধ লাগিয়ে দেওয়া হয়।
একজন বউ যখন পরিবারে আসে, তখন সে চায় কিছুটা আপনজন হতে। কিন্তু পরিবারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, অবিশ্বাস আর প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় তাকে যদি সন্দেহের চোখে দেখা হয়, তাহলে সে কখনোই স্থায়ী হতে পারে না।
আরও একটি বড় কারণ হলো—ভুলভাবে বুঝে নেওয়া ‘নারীর স্বাধীনতা’। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব কিংবা কিছু ওয়েবসাইট থেকে এক ধরনের নারীবাদ ছড়ানো হয়—যেখানে সংসার, মা হওয়া, কিংবা স্বামীর প্রতি দায়িত্ববোধকে দেখা হয় পরাধীনতা হিসেবে। বহু তরুণী এই ধারণা নিয়েই সংসার শুরু করেন। অন্যদিকে, বহু পুরুষও আছে যারা বিয়েকে ভাবে ‘কন্ট্রোলের মাধ্যম’। ফলে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়।
অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও এখন এক তরফা ডিভোর্সের অনুঘটক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আগে নারীরা কেবল নির্ভর করত স্বামীর আয়ে, তাই কোনো সমস্যায়ও টিকিয়ে রাখত সংসার। এখন অনেকেই আয় করছে, চাকরি করছে—যা ভালো; কিন্তু অনেকেই তখন ভাবতে শুরু করে—’আমি কেন সহ্য করব’? অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মানেই সম্পর্ক থেকে পালানোর সুযোগ—এই ধারণাটাই ভয়ংকর।
তবে পুরুষেরাও নির্দোষ নয়। বহু ছেলেই নিজের দায়িত্ব বোঝে না। বউকে সময় না দেওয়া, শ্বশুরবাড়িকে অসম্মান করা, কিংবা সন্দেহ প্রবণতা থেকেও বহু সংসার ভেঙে যাচ্ছে। স্ত্রীকে তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চাওয়ার প্রবণতাও মারাত্মক ভুল।
সংসার মানে শুধু দুটি মানুষ নয়—দুটি পরিবার। যদি পরিবারগুলো পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহনশীলতা, ও সীমা মানার শিক্ষা দেয়, তাহলে সম্পর্ক ভাঙে না।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন বহুমুখী সচেতনতা ও উদ্যোগ। প্রথমেই পরিবারে ছোটবেলা থেকেই সন্তানদের সম্পর্কের গুরুত্ব, সহানুভূতি ও সহনশীলতার শিক্ষা দিতে হবে। সন্তান যেন বুঝতে শেখে—সংসার মানেই শুধু ভালোবাসা নয়, বরং দায়িত্ব, ছাড় দেওয়া ও বোঝাপড়ার জায়গা।
মা-বাবাদেরও এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। সন্তানদের বিয়ের পর তারা যেন পরোক্ষভাবে সহায়কের ভূমিকা রাখেন, কখনোই অতিরিক্ত হস্তক্ষেপকারী হয়ে না ওঠেন। বাস্তব সংসার জীবনের চড়াই-উতরাই সম্পর্কে ছেলেমেয়েকে আগেই মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তোলা জরুরি। সংসার মানেই সবসময় মসৃণ চলার পথ নয়—এই বোধ তৈরি করে দেওয়া প্রয়োজন।
একইসাথে মিডিয়া, শিক্ষা ব্যবস্থা ও সামাজিক প্ল্যাটফর্মগুলোতে সম্পর্কের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার বাড়াতে হবে। তরুণ-তরুণীরা যেন শিখতে পারে—স্বাধীনতা মানেই দায়িত্ব থেকে মুক্তি নয়, বরং দায়িত্ববান হয়ে নিজের ও অন্যের জীবনের মানে গড়ে তোলা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিয়ের আগে উভয়পক্ষের মানসিক পরিপক্বতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও মূল্যবোধ যাচাই করা। শুধুমাত্র পরিবারিক পছন্দ বা বাহ্যিক চাহিদা নয়, বরং অন্তর্দৃষ্টি ও অনুভবের ভিত্তিতেই বিয়ে হওয়া উচিত—যা একটি সুস্থ ও দীর্ঘস্থায়ী সংসার গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
আমরা যদি এই জায়গাগুলোতে সচেতন হই, তবে শুধু বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা কমবে না, বরং গড়ে উঠবে ভালোবাসা, সহানুভূতি ও বিশ্বাসভিত্তিক পরিবার।
শেষ কথা হলো, সংসার ভাঙা সহজ, গড়ে তোলা কঠিন। কারো মা, কারো বোন, বা সোশ্যাল মিডিয়ার ফাঁদ—সবাই মিলে একটি সম্পর্ক গড়তে পারে, আবার ভেঙেও দিতে পারে। সিদ্ধান্ত আমাদের—আমরা কোনটা বেছে নেব?
লেখক: কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক