মানুষ সামাজিক জীব, আর সমাজ টিকে থাকে মানুষের পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার উপর ভিত্তি করে। আস্থা হলো সেই অদৃশ্য বন্ধন যা মানুষকে একে অপরের সাথে, প্রতিষ্ঠানের সাথে এবং সামগ্রিকভাবে সমাজের সাথে জুড়ে রাখে। এটি কেবল ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়, বরং ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, আইনকানুন, শিক্ষা এবং সমাজের প্রতিটি স্তরেই অপরিহার্য। যখন আমরা কাউকে বা কোনো প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বাস করি, তখন আমরা তাদের সততা, সক্ষমতা এবং শুভ উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত থাকি এবং সেই অনুযায়ী তাদের উপর নির্ভর করি। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে, দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপট এবং বিভিন্ন ঘটনার প্রবাহে এই মৌলিক আস্থায় যেন চিড় ধরেছে। সমাজে এক গভীর আস্থা সংকট পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা আমাদের মননে প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে: এই অনিশ্চিত সময়ে আমরা কাকে বিশ্বাস করব?
আস্থা হলো একটি জটিল মানসিক অবস্থা এবং সামাজিক নির্মাণ। সহজ ভাষায়, আস্থা হলো অন্য ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি এই বিশ্বাস রাখা যে তারা নির্ভরযোগ্য, সৎ এবং নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সঠিক কাজটি করবে। এটি নির্ভর করে অতীত অভিজ্ঞতা, খ্যাতি এবং অনুমানের উপর। আস্থা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত স্তরে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিস্তৃত হয়ে পারিবারিক আস্থা, সামাজিক আস্থা, প্রাতিষ্ঠানিক আস্থা (যেমন সরকার, বিচার বিভাগ, মিডিয়া, কর্পোরেশন) এবং এমনকি পদ্ধতির উপর আস্থা (যেমন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বা স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা) পর্যন্ত বিস্তৃত। যখন আমরা কারো উপর আস্থা রাখি, তখন আমরা নিজেদেরকে কিছুটা অরক্ষিত করি, কারণ আমরা বিশ্বাস করি যে অন্য পক্ষ আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নেবে না বা আমাদের ক্ষতির কারণ হবে না। এই বিশ্বাসই মানব সহযোগিতা, যোগাযোগ এবং স্থিতিশীলতার ভিত্তি তৈরি করে। আস্থা থাকলে লেনদেন সহজ হয়, সম্পর্ক দৃঢ় হয় এবং সমাজ মসৃণভাবে চলতে পারে।
সমাজে আস্থা সংকটের বহিঃপ্রকাশ নানাভাবে দৃশ্যমান। এর সবচেয়ে বড় লক্ষণ হলো সর্বত্র বিরাজমান সন্দেহ এবং অনাস্থা। মানুষ সহজেই অন্যকে সন্দেহ করে, তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব দেখা যায়, যেখানে বন্ধু, পরিবার বা সহকর্মীদের মধ্যেও ছোটখাটো বিষয়ে অবিশ্বাস জন্ম নেয়। সামাজিক স্তরে, প্রতিবেশীদের মধ্যে সহযোগিতার অভাব এবং পারস্পরিক দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে এই সংকট আরও ভয়াবহ। সরকার, রাজনৈতিক দল, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সংবাদ মাধ্যমের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের প্রতিও সাধারণ মানুষের আস্থা কমে গেছে। মানুষ মনে করে যে এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় বেশি আগ্রহী। অনলাইন জগতে এই অনাস্থা আরও তীব্র হয়। কে আসল আর কে ভুয়া, কোন তথ্য সঠিক আর কোনটি মিথ্যা, তা বোঝা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সমাজে এক ধরনের নৈরাশ্যবাদ ছড়িয়ে পড়ছে, যেখানে মানুষ কোনো ভালো কাজকেও সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। এই লক্ষণগুলোই প্রমাণ করে যে সমাজের গভীরে আস্থার অভাব কতটা ছড়িয়ে পড়েছে।
সমাজে এই গভীর আস্থা সংকটের পেছনে একাধিক জটিল কারণ বিদ্যমান। দুর্নীতি এর অন্যতম প্রধান কারণ। যখন মানুষ দেখে যে ক্ষমতা বা অর্থের অপব্যবহার হচ্ছে, যারা রক্ষক তারাই ভক্ষক হচ্ছে, তখন তাদের প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তিগত পর্যায়েও বিশ্বাস টলে যায়। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এবং জবাবদিহিতার অভাব আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা বা এমনকি ব্যবসায়ীরা যখন তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন না এবং তাদের ভুল বা অসদাচরণের জন্য জবাবদিহি করেন না, তখন মানুষ তাদের উপর থেকে আস্থা হারায়। দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়া মিথ্যা তথ্য বা অপতথ্যের বন্যাও আস্থা সংকটের একটি বড় কারণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যা মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করে এবং সত্য প্রতিষ্ঠানে (যেমন নির্ভরযোগ্য সংবাদ মাধ্যম) তাদের আস্থা কমিয়ে দেয়। সংবাদ মাধ্যমের পক্ষপাতিত্ত্বের কারণেও অনেক সময় মানুষ সত্য ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে না এবং মিডিয়ার উপর আস্থা হারায়। সমাজে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ বৃদ্ধি এবং প্রতিযোগিতার মনোভাবও অনেক সময় অন্যের প্রতি সহানুভূতি ও আস্থার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দ্রুত পরিবর্তনশীল আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি এবং অনিশ্চয়তাও মানুষকে শঙ্কিত করে তোলে এবং তারা নিজেদের গুটিয়ে নেয়, যার ফলে অন্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা কঠিন হয়। এছাড়া, কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিভেদ এবং মেরুকরণ ইচ্ছাকৃতভাবে সমাজে অবিশ্বাস ও অনাস্থার বীজ বপন করে, যাতে ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতি ঘৃণা ও সন্দেহ তৈরি হয়।
আস্থা সংকটের প্রভাব অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক এবং সুদূরপ্রসারী। ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে এর প্রথম প্রভাব পড়ে সম্পর্কের উপর। অবিশ্বাস সম্পর্কের ভিত্তি দুর্বল করে দেয়, ভুল বোঝাবুঝি বাড়ায় এবং দূরত্ব তৈরি করে। এটি পারিবারিক বন্ধন, বন্ধুত্ব এবং সামাজিক মেলামেশাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সমাজের সংহতি নষ্ট হয়। যখন মানুষ একে অপরের উপর বিশ্বাস রাখতে পারে না, তখন তারা একত্রিত হয়ে কোনো সমস্যা সমাধান করতে বা সাধারণ লক্ষ্যের জন্য কাজ করতে ব্যর্থ হয়। এটি সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করে এবং সংঘাতের ঝুঁকি বাড়ায়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও আস্থার অভাব মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং লেনদেনের জন্য আস্থা অপরিহার্য। যখন ব্যবসায়ীরা বা বিনিয়োগকারীরা সিস্টেমে বা অন্যান্য পক্ষের উপর আস্থা রাখতে পারে না, তখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শ্লথ হয়ে যায়। রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ে। জনগণ যখন সরকার বা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার উপর আস্থা হারায়, তখন গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে, আইন মেনে চলার প্রবণতা কমে যায় এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। মনস্তাত্ত্বিকভাবেও আস্থা সংকট মানুষের উপর চাপ সৃষ্টি করে। ক্রমাগত সন্দেহ এবং অবিশ্বাস মানুষকে মানসিকভাবে ক্লান্ত করে তোলে, উদ্বেগ এবং একাকীত্ব বাড়ায়। ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরনের হতাশা এবং নৈরাশ্য তৈরি হয়, কারণ তারা দেখে যে কেউই নির্ভরযোগ্য নয়।
যেহেতু আস্থা সংকটের প্রভাব এত ভয়াবহ, তাই এটি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করা অত্যন্ত জরুরি। আস্থা পুনরুদ্ধার একটি সুস্থ, স্থিতিশীল এবং প্রগতিশীল সমাজ গঠনের জন্য অপরিহার্য। আস্থা ছাড়া কার্যকর সহযোগিতা অসম্ভব। অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক কল্যাণ – সব ক্ষেত্রেই সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন, যা আস্থার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। আস্থা সামাজিক পুঁজি বৃদ্ধি করে, যা সমাজের মানুষের মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্ক এবং নেটওয়ার্ক তৈরি করে, যা সংকট মোকাবিলা এবং উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আস্থা সমস্যা সমাধান এবং সংঘাত নিরসনে সাহায্য করে, কারণ এটি বিভিন্ন পক্ষকে আলোচনার টেবিলে বসতে এবং গঠনমূলক সমাধানে পৌঁছাতে উৎসাহিত করে। এটি সুশাসন এবং জবাবদিহিতার জন্য জরুরি। যখন নাগরিকরা সরকার এবং প্রতিষ্ঠানের উপর আস্থা রাখে, তখন তারা সিস্টেমের অংশ হতে উৎসাহিত হয় এবং তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারে। সর্বোপরি, আস্থা মানুষের মানসিক শান্তি এবং সুখের জন্য অপরিহার্য। একটি সমাজে যেখানে মানুষ একে অপরের উপর বিশ্বাস রাখতে পারে, সেখানে জীবন অনেক সহজ, নিরাপদ এবং আনন্দময় হয়।
আস্থা পুনরুদ্ধার একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া এবং এর জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক এবং সামাজিক পর্যায়ে সমন্বিত প্রচেষ্টা। ব্যক্তিগতভাবে, আমাদের সততা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা এবং স্বচ্ছতার চর্চা করতে হবে। ছোট ছোট পরিসরে হলেও আমাদের আচরণের মাধ্যমে দেখাতে হবে যে আমরা নির্ভরযোগ্য। অন্যের সাথে খোলাখুলিভাবে কথা বলা, মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শোনা এবং তাদের অনুভূতির প্রতি সংবেদনশীল হওয়া আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করে। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। সরকারি এবং বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানকে তাদের কার্যক্রম এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছ হতে হবে। দুর্নীতি এবং অসদাচরণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং দোষীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। সংবাদ মাধ্যমকে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে হবে এবং ভুল তথ্যের প্রচার বন্ধ করতে হবে। নাগরিকদের মিডিয়া সাক্ষরতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা সঠিক তথ্য যাচাই করতে পারে এবং মিথ্যা তথ্যের শিকার না হয়। শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক মূল্যবোধ এবং নাগরিক দায়িত্ববোধের উপর জোর দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে এবং সৎ নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। তাদের আচরণে সততা, জনকল্যাণের প্রতি নিষ্ঠা এবং জবাবদিহিতা থাকতে হবে। সামাজিক সংহতি বৃদ্ধির জন্য পাড়া-মহল্লা বা কমিউনিটি পর্যায়ে নানা ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে, যা মানুষের মধ্যে মেলামেশা এবং পারস্পরিক নির্ভরতা বাড়াতে সাহায্য করবে।
আস্থা সংকট নিঃসন্দেহে আধুনিক সমাজের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা কাকে বিশ্বাস করব – এই প্রশ্নটি আমাদের সময়ের গভীর উদ্বেগকেই প্রতিফলিত করে। এই সংকট সমাজের ভিত্তি দুর্বল করে দিচ্ছে এবং এর নেতিবাচক প্রভাব সর্বব্যাপী। দুর্নীতি, মিথ্যা তথ্য, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এবং স্বচ্ছতার অভাব এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। তবে, পরিস্থিতি কঠিন হলেও আস্থা পুনরুদ্ধার অসম্ভব নয়। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া যার জন্য প্রয়োজন সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। ব্যক্তিগত সততা, প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, এবং সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতা ও সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা ধীরে ধীরে হারানো আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারি। এটি একটি কঠিন পথ, কিন্তু একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ এবং সুখী সমাজের জন্য এটি অপরিহার্য। আসুন আমরা সকলে মিলে এমন একটি পরিবেশ তৈরির জন্য কাজ করি যেখানে মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করতে পারে, যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলো নির্ভরযোগ্য হয় এবং যেখানে সত্য ও সততা সর্বাগ্রে স্থান পায়। শুধুমাত্র তখনই আমরা আস্থা সংকটের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারব এবং নিজেদের জন্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যৎ গড়তে পারব।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা