কাশ্মীর—যা প্রকৃতির অনুপম সৌন্দর্য, ইতিহাসের গৌরব, ধর্ম-সংস্কৃতির বৈচিত্র্য এবং রাজনৈতিক সংঘাতের এক ব্যতিক্রমী প্রতিচ্ছবি। একসময়ের শান্তির উপত্যকা আজ পরিণত হয়েছে উত্তেজনার কেন্দ্রে, যেখানে ইতিহাস, ভূরাজনীতি ও মানবিক বেদনার এক গভীর সমীকরণ চলমান।
মোগল সম্রাট শাহজাহান যখন দিল্লির লালকেল্লায় দেওয়ান-ই-খাস নির্মাণ করেন, তখন তার প্রাসাদের সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে গিয়ে ব্যবহার করেন ত্রয়োদশ শতাব্দীর কবি আমির খসরুর লেখা এক বিখ্যাত ফারসি পঙক্তিমালা: ‘আগার ফেরদৌস বার রুয়ে জমিন আস্ত, হামীন আস্ত, হামীন আস্ত, হামীন আস্ত।’ অর্থাৎ, ‘যদি পৃথিবীতে কোনো স্বর্গ থাকে, তবে এটাই, এটাই, একমাত্র এটাই।’
অথচ এই কবিতা রচিত হয়েছিল কাশ্মীর উপত্যকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখেই, দেওয়ান-ই-খাস তৈরির বহু বছর আগে। সত্যিই কাশ্মীর, হিমালয় আর পিরপাঞ্জালের কোলে বিস্তৃত এক স্বপ্নিল ভূখণ্ড, যেখানে প্রকৃতির রূপের সব ঐশ্বর্য এসে মিলিত হয়েছে। শ্রীনগর, পেহেলগাম, গুলমার্গ, সোনমার্গের মতো মনোমুগ্ধকর স্থান পর্যটকদের আজও আকৃষ্ট করে। পপলার আর উইলো গাছের সারি, সবুজ শস্যক্ষেত্র, আর দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড় যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোনো ছবি।
তবে এই রূপকথার রাজ্যের ইতিহাস রক্ত আর বেদনার। পঞ্চম শতাব্দীর আগে কাশ্মীর ছিল হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। নবম শতাব্দীতে এখানে শৈববাদের উত্থান ঘটে। ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইসলাম ধর্মের বিস্তার ঘটলে শৈব প্রভাব কমে আসে, কিন্তু পূর্বের সংস্কৃতি নবাগত ইসলামি সংস্কৃতির সাথে মিশে জন্ম দেয় কাশ্মীরি সুফিবাদের। ১৩৩৯ সালে শাহ মীর কাশ্মীরের প্রথম মুসলিম শাসক হন, যার হাত ধরে পাঁচ শতাব্দীব্যাপী মুসলিম শাসনের সূচনা হয়। মুঘল ও আফগান দুররানী সম্রাটরাও এই ভূখণ্ড শাসন করেছেন। ১৮১৯ সালে শিখরা এবং ১৮৪৬ সালে ইংরেজরা কাশ্মীরের কর্তৃত্ব লাভ করে।
ভারত বিভাগের সময় কাশ্মীর এক জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু রাজা হরি সিং ভারতের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে গড়িমসি করতে থাকেন। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, যার পূর্বপুরুষ ছিলেন কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ, এই অঞ্চলের প্রতি বিশেষ দুর্বল ছিলেন। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সহায়তায় তিনি হরি সিংকে ভারতভুক্তির পক্ষে রাজি করান। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে জম্মুতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) প্রত্যক্ষ মদদে ব্যাপক মুসলিম গণহত্যা চালানো হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল জনসংখ্যার ভারসাম্য পরিবর্তন করা।
পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কাশ্মীরকে অধিগ্রহণের জন্য সেনাবাহিনী পাঠানোর নির্দেশ দেন। এই খবর পৌঁছালে হরি সিং ভারতের সাহায্য চান। ভারতীয় বাহিনী প্রবেশ করলে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়, যার ফলস্বরূপ কাশ্মীরের এক-তৃতীয়াংশ পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। জাতিসংঘ হস্তক্ষেপ করে গণভোটের প্রস্তাব দিলেও ভারত কখনোই তা কার্যকর করেনি। বরং রাজা হরি সিংয়ের পুত্র ড. করণ সিংকে ভারত-অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরের সদরে রিয়াসত এবং শেখ আবদুল্লাহকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করে।
কালের আবর্তে, ভারত ধীরে ধীরে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নিতে শুরু করে। শেখ আবদুল্লাহ, একসময়ের নেহরুর বন্ধু, এই চুক্তিভঙ্গে ব্যথিত হয়ে স্বাধীনতার দিকে ঝুঁকেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাকে কারাবন্দী করা হয়। দীর্ঘ দশ বছর পর মুক্তি পেয়ে তিনি কিছু শর্ত মেনে নিয়ে আধীনতার দাবি থেকে সরে আসেন এবং মুখ্যমন্ত্রী হন। তবে ততদিনে তিনি রাজ্যের মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ের শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।
নেহরু ও শেখ আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন আরও সংকুচিত হতে থাকে। উপত্যকার যুবকদের মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়, যা দমনের জন্য ভারত সেখানে সেনা শাসন জারি করে। হত্যা ও জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে স্বাধীনতার স্পৃহাকে স্তব্ধ করে দিতে চাওয়া হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় সশস্ত্র বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ভারত এসব যোদ্ধাকে জঙ্গি ও বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে এবং পাকিস্তানের মদদের অভিযোগ তোলে। কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বহুবার যুদ্ধ হয়েছে, কিন্তু কোনো স্থায়ী সমাধান আসেনি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের মিত্রশক্তির ভূমিকা এবং পরবর্তীতে সিমলা চুক্তিতে কাশ্মীরকে দ্বিপাক্ষিক সমস্যা হিসেবে মেনে নেওয়া হয়। তবে ২০১৯ সালে বিজেপি সরকার ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। উপত্যকা পরিণত হয় এক বন্দি শিবিরে, যেখানে সেনাশাসন জারি থাকে এবং স্বাধীনতার কণ্ঠস্বর অস্ত্রের মুখে কেড়ে নেওয়া হয়।
সম্প্রতি পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় বহু পর্যটকের মৃত্যু হয়, যার জন্য ভারত কোনো প্রমাণ ছাড়াই পাকিস্তানকে দায়ী করে। এমনকি এই হামলাকে ভারতের ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’ বলেও অনেকে মনে করেন। এর জের ধরে ভারত আজাদ কাশ্মীর ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলা চালায়, যাতে বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়। পাকিস্তানও এর পাল্টা জবাব দেয়। পারমাণবিক শক্তিধর দুটি দেশের এই সংঘাত দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক গভীর উদ্বেগের কারণ।
অশোকের সময় বৌদ্ধ সন্ন্যাসী মজ্জাস্তিকা কাশ্মীরে অহিংসার বাণী প্রচার করেছিলেন। কথিত আছে, যিশুখ্রিস্টও এই ভূমিতে এসেছিলেন। হজরতবাল দরগাহে সংরক্ষিত আছে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র কেশদাম। শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানকের স্মৃতিও এখানে অমলিন। অথচ সেই শান্তির উপত্যকা আজ রক্তে রঞ্জিত। বারুদের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। সুন্দর, শান্তিকামী কাশ্মীরি মানুষ বুটের তলায় পিষ্ট হচ্ছে।
আজ কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা, এই যুদ্ধ যেন দ্রুত থেমে যায়। এই ঘটনাপ্রবাহ যেন কাশ্মীরকে মুক্তির পথে নিয়ে যায়। এই দশক যেন কাশ্মীর উপত্যকার মুক্তির দশক হয়।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়