আমরা যারা প্রতিদিন স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবি, পুষ্টিকর খাবার খেতে চাই, প্রাকৃতিক খাদ্য বেছে নেওয়ার চেষ্টা করি, তারা অনেক সময়ই মৌসুমি ফলকে জীবনের এক অনন্য আশীর্বাদ হিসেবে দেখি। প্রকৃতি প্রতিটি ঋতুতে আমাদের জন্য এনে দেয় ভিন্ন ভিন্ন ফলের সম্ভার। কখনো গ্রীষ্মে পাকা আম ও তরমুজের মিষ্টি স্বাদ, কখনো বর্ষায় পেয়ারা ও জাম, কখনো শীতে কমলা ও মালটার পুষ্টিসমৃদ্ধ রস। মৌসুমি ফল শুধু আমাদের স্বাদের তৃপ্তি মেটায় না, বরং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, হজমশক্তি উন্নত করে এবং সার্বিক সুস্থতা নিশ্চিত করে। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই ফল খাওয়ার আগেও সংশয় জাগে—এটি কি আদৌ নিরাপদ? এটি কি প্রকৃতির দেওয়া ফল, নাকি রাসায়নিকের ফাঁদে জড়ানো বিষাক্ত এক খাদ্য? এ প্রশ্ন এখন শুধু শহরের নয়, গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের মুখেও উচ্চারিত হয়। কারণ, আজ মৌসুমি ফলের পেছনে প্রকৃতির ছোঁয়ার চেয়ে বেশি ছায়া ফেলেছে কেমিকেলের ভয়াল থাবা।
বর্তমান কৃষি ব্যবস্থায় দ্রুত মুনাফার আশায় অনেক ফল চাষিরা রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করেন। এদের মধ্যে অন্যতম হলো ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথিফন, সালফার ডাই-অক্সাইড, ফরমালিন ইত্যাদি। এসব পদার্থ ফল পাকাতে, রং বাড়াতে বা দীর্ঘদিন তাজা রাখার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। তবে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভয়াবহ। ক্যালসিয়াম কার্বাইড ফলের ভেতরে থাকা প্রাকৃতিক এনজাইমের কার্যক্রমকে ব্যাহত করে, ফলে ফল পাকে না—বরং তা রস, সুগন্ধ ও পুষ্টি হারিয়ে এক ধরনের দেহবিনাশী বস্তুর রূপ নেয়। ইথিফন নামক রাসায়নিক ব্যবহারে ফল কৃত্রিমভাবে পেকে যায়, যার ফলে মানুষের হজম প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো ফরমালিন, যা একটি সংরক্ষণকারী পদার্থ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি দেহে প্রবেশ করে কিডনি, লিভার এমনকি স্নায়ুতন্ত্রেও প্রভাব ফেলে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, দীর্ঘমেয়াদে এই রাসায়নিক পদার্থ ক্যানসারসহ প্রাণঘাতী বহু রোগের কারণ হতে পারে।
এক সময় গ্রামবাংলার বাড়ির আঙিনায় ফলগাছ ছিল সাধারণ দৃশ্য। বাড়ির বাগানে আম, লিচু, জাম কিংবা কাঁঠালের ফল পাড়ার আনন্দে শিশুদের চোখ জ্বলজ্বল করত। সেই ফল খাওয়া যেত নির্ভয়ে, মাটি থেকে উঠে আসা একটি উপহার হিসেবেই। এখন সেই ছবিটা বদলে গেছে। অধিকাংশ ফলই শহরের বাজারে আসে দূরদূরান্ত থেকে, যেখানে ফল কীভাবে চাষ হলো, কী ধরনের সার বা কীটনাশক ব্যবহৃত হলো—তা সাধারণ মানুষ জানেই না। ফলের রঙ সুন্দর হলে, গায়ে চকচকে আবরণ থাকলে, দামের তুলনায় ফল বড় হলে মানুষ ভাবে, এটি নিশ্চয়ই ভালো ফল। অথচ এই বাহ্যিক সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকে বিপদের হাতছানি।
মৌসুমি ফল হওয়া উচিত ছিল সুস্থ জীবনের প্রতীক। এসব ফলের স্বাভাবিক গঠন, রঙ, স্বাদ ও সুগন্ধে শরীর পায় প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও আঁশ। এগুলো শরীরকে বিষমুক্ত করে, হজম সহজ করে, হৃদযন্ত্রকে সজীব রাখে এবং দেহের কোষগুলিকে চাঙ্গা রাখে। কিন্তু রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে এই ফলগুলো উল্টো দেহে বিষ ছড়িয়ে দেয়। শিশুরা এর কারণে পেটের সমস্যা, হজমের জটিলতা, দাঁতের ক্ষয় এমনকি নিউরোলজিকাল সমস্যা পর্যন্ত নিয়ে ভোগে। বৃদ্ধদের শরীর আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয় এসব কেমিকেলযুক্ত ফলের কারণে। শুধু শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও এদের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে দেখা গেছে। বিষাক্ত ফলের কারণে যখন মানুষের শরীর ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন কাজের উৎপাদনশীলতা কমে, পরিবারে অসন্তোষ বাড়ে এবং সামগ্রিক জীবনে বিষন্নতা ছড়িয়ে পড়ে।
এই অবস্থার পরিবর্তন আনতে চাইলে আমাদের সবার প্রথমে প্রয়োজন সচেতনতা। কেমিকেলমুক্ত মৌসুমি ফলের চাহিদা আমাদের কণ্ঠে নয়, কাজে ফুটে উঠতে হবে। আমরা যারা ভোক্তা, তাদের উচিত ফল কেনার সময় বাহ্যিক সৌন্দর্যের মোহে না পড়ে, নিরাপদ উৎস থেকে ফল সংগ্রহ করা। বাজারে কোনো ফল অতিরিক্ত উজ্জ্বল বা অসময়ে পাওয়া গেলে সে ফলকে সন্দেহের চোখে দেখা উচিত। ফল কিনে তা ভালোভাবে ধোয়া, খোসা ছাড়িয়ে খাওয়া এবং প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা খুবই জরুরি। আমাদের নিজস্ব উঠানে, ছাদে বা খোলা জায়গায় মৌসুমি ফলের গাছ লাগানোও হতে পারে নিরাপদ ফলের একটি সহজ সমাধান। এটি শুধু স্বাস্থ্য সুরক্ষা নয়, বরং আমাদের সন্তানদের জন্য একটি সচেতন প্রজন্ম গড়ার শিক্ষাও বয়ে আনবে।
সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেরও এখানে ভূমিকা রয়েছে। বাজারে কেমিকেল ব্যবহার ঠেকাতে হলে কঠোর নজরদারি, মোবাইল কোর্ট, নিয়মিত রাসায়নিক পরীক্ষা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। একইসঙ্গে প্রয়োজন নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। যদি কৃষক বুঝতে পারেন কোন রাসায়নিক কতটা ক্ষতিকর এবং কোন প্রাকৃতিক উপায়ে ফল চাষ লাভজনক হতে পারে, তবে তারাও ধীরে ধীরে রাসায়নিক নির্ভরতা থেকে সরে আসবেন। এখানে মিডিয়া, সামাজিক সংগঠন ও স্থানীয় প্রশাসন ভূমিকা রাখতে পারে সচেতনতামূলক প্রচার চালিয়ে।
বর্তমানে শহরাঞ্চলে অর্গানিক ফল বা জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফলের দিকে ঝোঁক বাড়ছে। যদিও এসব ফলের দাম তুলনামূলক বেশি, তবুও মানুষ এতে আগ্রহ দেখাচ্ছে কারণ তারা বুঝতে পারছে—স্বাস্থ্যই সব থেকে বড় সম্পদ। এই আগ্রহকে পুঁজি করে স্থানীয় কৃষকরাও জৈব পদ্ধতিতে মৌসুমি ফল উৎপাদনে আগ্রহী হতে পারেন। তাদের জন্য আর্থিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও বাজার নিশ্চিত করা গেলে দেশে এক ধরনের খাদ্য বিপ্লব সম্ভব। এতে করে কেবল ভোক্তার স্বাস্থ্যই রক্ষা পাবে না, বরং দেশের অর্থনীতিতেও একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে। মৌসুমি ফল প্রকৃতি আমাদের যেভাবে দিয়েছে, ঠিক সেভাবেই খাওয়া উচিত। তাতে যেমন স্বাস্থ্য রক্ষা হবে, তেমনি রক্ষা পাবে পরিবেশ, সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। আমরা চাই এমন এক সমাজ, যেখানে বাজারে পাকা আম কিনে শিশুদের হাতে তুলে দেওয়া যাবে নিশ্চিন্তে, যেখানে লিচুর টাটকা গন্ধেই বোঝা যাবে এটি প্রকৃতির স্পর্শে বেড়ে উঠেছে, আর যেখানে মৌসুমি ফল হবে ভয় নয়, নির্ভেজাল পুষ্টির উৎস। সে জন্য একটাই দাবি—কেমিকেল মুক্ত মৌসুমি ফল চাই।
লেখক: শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ, ফেনী