Monday 12 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মাল্টিপ্লেক্সহীন খুলনা: আধুনিক শহরে এক অসম্পূর্ণতা

রিয়াজুল হক
১১ মে ২০২৫ ১৮:৩৭

খুলনা দেশের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। একসময় ছিল দেশি-বিদেশি পণ্যের কেন্দ্র, নদীবন্দর, কাগজ, রপ্তানি পণ্য, নৌ ও রেল যোগাযোগে এক সমৃদ্ধ জনপদ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খুলনা হারিয়েছে তার অনেক ঐতিহ্য। তবু এখানে আছে বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, শিপইয়ার্ড, সরকারি-বেসরকারি অফিস, লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মব্যস্ত জীবন। এই শহরে প্রতিদিন গড়ে ওঠে স্বপ্ন, তবে বিনোদনের বেলায় এখনো এক গভীর শূন্যতা রয়ে গেছে। খুলনায় নেই একটি আধুনিক মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা হল।

বিজ্ঞাপন

ঢাকায় এখন একাধিক মাল্টিপ্লেক্সে প্রতিদিন মুক্তি পায় নতুন সিনেমা। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশালসহ অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোতেও একাধিক মাল্টিপ্লেক্স চালু হয়েছে বা নির্মাণাধীন। কিন্তু খুলনার মতো একটি শহরে এখনো সেই সুযোগ নেই। ২০২৫ সালে দাঁড়িয়েও এখানকার মানুষকে সিনেমা দেখতে হলে যেতে হয় পুরোনো হলগুলোতে, যেগুলোর পরিবেশ, পরিকাঠামো, প্রযুক্তি, যার সবই কয়েক দশক পুরোনো। আবার পুরোনো অনেকগুলো সিনেমা হল ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন

প্রশ্ন আসতে পারে, কেন দরকার মাল্টিপ্লেক্স? মাল্টিপ্লেক্স মানে শুধু আধুনিক সিনেমা হল নয়। এটি একটি সুসংগঠিত, নিরাপদ এবং পরিবারবান্ধব বিনোদনকেন্দ্র। যেখানে একই ভবনে একাধিক সিনেমা চলে, দর্শক পছন্দ অনুযায়ী সময় ও বিষয় বেছে নিতে পারেন। আন্তর্জাতিক মানের স্ক্রিন, শব্দ, আসনব্যবস্থা এবং পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, সব মিলিয়ে মাল্টিপ্লেক্স এখন শুধু শহুরে জীবনের বিলাসিতা নয়, বরং প্রয়োজনীয়তা।

বিশ্বজুড়ে শহরগুলো আজ মাল্টিপ্লেক্সকে ব্যবহার করছে শুধু সিনেমা নয়, একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে। সেখানে হয় চলচ্চিত্র উৎসব, শিশুদের জন্য বিশেষ প্রদর্শনী, তরুণ নির্মাতাদের কাজ দেখানোর সুযোগ। খুলনায় এই ধরনের প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজন দিন দিন বাড়ছে।

বিশেষ করে তরুণদের জন্য সুস্থ বিনোদনের সুযোগ দিন দিন কমে যাচ্ছে। অনলাইন কনটেন্ট, সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা মোবাইল গেমের মাধ্যমে এখনো কিছুটা সময় কাটানো গেলেও সেখানে নেই কোনো সামাজিক সংযোগ, নেই বাস্তব যোগাযোগের সুযোগ। একসঙ্গে বন্ধু বা পরিবার নিয়ে সিনেমা দেখার মতো অভিজ্ঞতা এসব মাধ্যমে আসে না। এতে করে একাকিত্ব, মানসিক চাপ এমনকি হতাশা তৈরি হয়। একটি ভালো সিনেমা হলে যাওয়া শুধু বিনোদন নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী।

অথচ খুলনায় বর্তমানে যে কয়েকটি সিনেমা হল টিকে আছে, তার মধ্যে বেশিরভাগই রক্ষণাবেক্ষণহীন। কোথাও আসন ভাঙা, কোথাও শব্দ বিকৃত, কোথাও আবার নিরাপত্তার অভাব। অনেক পরিবার তাই সিনেমা হলে যাওয়া একপ্রকার এড়িয়েই চলেন। তরুণদের অনেকেই নতুন সিনেমা দেখতে ঢাকায় যান, কিংবা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে দেখেন।

আরও আশ্চর্যের বিষয়, খুলনার চেয়ে পিছিয়ে থাকা জেলাগুলোতেও এখন আধুনিক সিনেমা হল গড়ে উঠছে। অথচ খুলনার মতো বিভাগীয় শহরেই নেই একটি মানসম্মত মাল্টিপ্লেক্স।

খুলনায় মাল্টিপ্লেক্স গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন প্রথমে একটি যৌক্তিক ব্যবসায়িক পরিকল্পনা। এ শহরে বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি প্রতিষ্ঠান, বহুসংখ্যক স্কুল-কলেজ, উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করা হাজারো পেশাজীবী এবং বিশাল এক বৃহৎ মধ্যবিত্ত শ্রেণি আছে, যারা নিয়মিত সিনেমা দেখতে চান। তারা সিনেমা দেখেন, তবে সেটা মোবাইল কিংবা ল্যাপটপে। যদি আধুনিক সুবিধাসহ নিরাপদ পরিবেশে সিনেমা দেখার সুযোগ থাকে, তাহলে এর ব্যবহার নিশ্চিতভাবেই হবে।

বিনিয়োগের জন্য বড় কোনো গ্রুপ যেমন স্টার সিনেপ্লেক্স, ব্লকবাস্টার, যমুনা ফিউচার পার্কের সিনেপ্লেক্স, এমনকি স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এগিয়ে আসতে পারেন। খালি পড়ে থাকা শপিং মল, কম খরচে ভাড়ায় পাওয়া যায় এমন ভবন অথবা সরকারি জমি, এসব কিছুই হতে পারে মাল্টিপ্লেক্স গড়ে তোলার সম্ভাব্য জায়গা।

সরকার যদি কর রেয়াত, বিদ্যুৎ সংযোগে সহায়তা বা অনুমোদন প্রক্রিয়াকে সহজ করে দেয়, তবে বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি একটি আকর্ষণীয় উদ্যোগ হতে পারে। এ ছাড়া স্থানীয় সরকারের দিক থেকেও এমন উদ্যোগে উৎসাহ ও সমর্থন জরুরি।

খুলনা শহরকে যদি একটি আধুনিক নগরী হিসেবে ভাবা হয়, তবে সেখানে মাল্টিপ্লেক্স না থাকাটা শুধু দুঃখজনকই নয়, একপ্রকার লজ্জাজনকও বটে। নগরের সৌন্দর্য বা পরিকাঠামো শুধু রাস্তা, ব্রিজ বা ভবন দিয়ে তৈরি হয় না। শহরকে বসবাসযোগ্য করে তোলে তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসর। সিনেমা হল, পার্ক, লাইব্রেরি, গ্যালারি, থিয়েটার, এই সবকিছুই একটি শহরকে প্রাণবন্ত করে তোলে।

আজ যারা সিনেমা দেখছেন না, তার মানে এই নয় যে তাদের আগ্রহ নেই। বরং উপযুক্ত পরিকাঠামো না থাকার কারণেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। খুলনায় একটি আধুনিক মাল্টিপ্লেক্স তৈরি হলে শুধু সিনেমা দর্শকই বাড়বে না, বরং এটি হবে নতুন একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।

একটি মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা হল এখন আর বিলাসিতা নয়, এটি একটি আধুনিক শহরের অপরিহার্য অংশ। খুলনা শহর যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে মাল্টিপ্লেক্সের মতো একটি বিনোদন অবকাঠামো এখনই সময়ের দাবি। এটি শুধু তরুণদের আনন্দ দেবে না, বরং শহরজুড়ে একটি নতুন গতি আনবে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে। সরকার, বিনিয়োগকারী ও নাগরিক সমাজের অংশীদারিত্বে এখন দরকার একটি সমন্বিত উদ্যোগ।

লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

সারাবাংলা/এএসজি

খুলনা মাল্টিপ্লেক্স মুক্তমত রিয়াজুল হক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর