Tuesday 13 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্বাস্থ্যসেবা না, স্বাস্থ্যবাণিজ্য

মোহাম্মদ নুর হোসেন নয়ন
১৩ মে ২০২৫ ১৫:৫৪

স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক অধিকার হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই অধিকার এখন পরিণত হয়েছে নির্মম এক বাণিজ্যে। হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো রোগীকে সুস্থতার আশ্বাস দিলেও, বাস্তবে সেগুলো নিছক মুনাফার কারখানায় পরিণত হয়েছে। একজন রোগী যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আসে, তখন তার একমাত্র প্রত্যাশা থাকে উপযুক্ত চিকিৎসা এবং সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক এই দুর্বলতাকে পুঁজি করে রুগীকে আর্থিক নিপীড়নের চক্রে ফেলে দেয়। রোগীর অসহায়তাকে ব্যবহার করে তারা পরিণত করেছে রোগীকে লাভজনক পণ্যে। অপ্রয়োজনীয় টেস্ট, অতিরিক্ত ঔষধ, অহেতুক চিকিৎসা—সবই চলছে লাভের নেশায়। এভাবে রোগীর জীবন নিয়ে তারা খেলছে জুয়া। মানবিক মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে তারা সমাজে এক ভয়ঙ্কর অনাচার ও অবিচারের সংস্কৃতি তৈরি করছে। নিয়ন্ত্রণহীন এই খাত আজ আর মানুষের সুস্থতার সেবক নয়; বরং নিঃস্ব করার নিষ্ঠুর যন্ত্রে পরিণত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থা আরও করুণ। যথাযথ সেবা প্রদান তো দূরের কথা, চিকিৎসক-নার্সদের দায়িত্বহীনতা ও অবহেলায় জনগণ বাধ্য হয়ে বেসরকারি খাতে ঝুঁকছে। জরুরি সেবায় শৃঙ্খলার অভাব, পর্যাপ্ত জনবল সংকট, অব্যবস্থাপনা সব মিলিয়ে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে তুলেছে। ফলে বেসরকারি হাসপাতালগুলো তাদের খেয়াল খুশি মতো রোগীকে ভীত করে তুলছে এবং অতিরিক্ত খরচ চাপিয়ে দিচ্ছে। ভয় দেখিয়ে অহেতুক টেস্ট করানো, অপ্রয়োজনীয় অপারেশন চাপিয়ে দেওয়া—এসব যেন খোলাখুলি বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে, সিজারিয়ান অপারেশনের নামে চলছে ভয়ঙ্কর বাণিজ্য। যেখানে স্বাভাবিক প্রসবের সম্ভাবনা থাকার পরও অস্ত্রোপচার চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে যেমন রোগীর শরীরিক ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি তার পরিবারও মারাত্মক আর্থিক বিপর্যয়ে পড়ছে। স্বাস্থ্যখাতে এখন চলছে এক নৈতিকতাহীন প্রতিযোগিতা। যেখানে রোগীর জীবন বা সুস্থতা নয়, মুনাফাই একমাত্র লক্ষ্য। এই অনিয়ন্ত্রিত খাত সমাজকে এক ভয়ঙ্কর সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে অসংখ্য হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এখনো লাইসেন্স ছাড়াই চলছে। সেখানে ডাক্তার নামধারী একদল অসাধু ব্যক্তি, ওষুধ কোম্পানির কমিশনের লোভে পড়ে রোগীদের অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও ওষুধ লিখে দিচ্ছেন। নীতিমালার অভাব তো আছেই, ন্যূনতম মানবিকতাও অনুপস্থিত। চিকিৎসকের শপথ ভুলে তারা শুধুই রোগীর পকেট খালি করার কাজে ব্যস্ত। অনেক চিকিৎসক ঔষধ কোম্পানির লোভনীয় অফারে পা দিয়ে এমন সব ওষুধ লিখছেন, যা রোগীর ক্ষতির পাশাপাশি তাকে সর্বস্বান্ত করে দিচ্ছে। এর ফলে সমাজে অসুস্থতা ও দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ছে এবং রোগীরা সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালের নৈরাজ্য এবং বেসরকারি খাতের দাপট মিলে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা পাওয়া প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে অধিক খরচে মানহীন বেসরকারি সেবায় ঝুঁকছে।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে স্বাস্থ্যখাতে দৃশ্যমান সংস্কার প্রয়োজন। সরকারকে কঠোর নজরদারি, দুর্নীতি দমন এবং মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসকদের পেশাগত নৈতিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, প্রশিক্ষণের মান বৃদ্ধি এবং মানবিক মূল্যবোধের চর্চা বাধ্যতামূলক করা জরুরি। নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। বর্তমান যুগে স্বাস্থ্যখাতে তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করতে না পারলে এই সংকট আরও গভীর হবে। প্রতিটি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সেবা মূল্য, রোগীর চিকিৎসার খরচ, ওষুধের দামের স্বচ্ছ তালিকা অনলাইনে প্রকাশ এবং সার্বজনীন অভিযোগ ব্যবস্থাপনা চালু করা দরকার। প্রতিটি রোগীর চিকিৎসা প্রক্রিয়ার রেকর্ড ডিজিটালি সংরক্ষণ করা হলে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সহজেই শনাক্ত করা যাবে। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে একটি নির্দিষ্ট অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এসব সেবা কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করলে অপচয়, প্রতারণা এবং রোগী হয়রানি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।

শহরকেন্দ্রিক চিকিৎসা কাঠামো বাংলাদেশে একটি বৈষম্যমূলক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। যেখানে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবার জন্যও শহরমুখী। অথচ এই চাপ কমাতে হলে প্রত্যন্ত এলাকাগুলোর কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং উপজেলা হাসপাতালের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ, দক্ষ চিকিৎসক নিয়োগ, ল্যাব সুবিধা এবং জরুরি পরিষেবা সুনিশ্চিত করলে মানুষ প্রাথমিক পর্যায়েই চিকিৎসা পেয়ে জটিলতা কমিয়ে আনতে পারবে। এটি শুধু স্বাস্থ্যসেবা নয়, সমাজের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্যও জরুরি। স্বাস্থ্যসেবায় শ্রেণিভিত্তিক বৈষম্য এখন বাংলাদেশের এক নির্মম বাস্তবতা। যেখানে ধনী ও প্রভাবশালীরা পাচ্ছেন উন্নত চিকিৎসা সুবিধা, আর দরিদ্র ও সাধারণ মানুষ পড়ছেন অবহেলিত।

এই অসমতা দূর করতে রাষ্ট্রীয় আইনি কাঠামো শক্তিশালী করতে হবে। লাইসেন্সবিহীন হাসপাতাল, অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং প্রতারক ডাক্তারদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। রোগী নির্যাতন, প্রতারণা, ভুয়া চিকিৎসা প্রদানের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে এই স্বাস্থ্যবানিজ্য থামবে না। এই সংকট শুধু প্রশাসনিক বা আইনগত নয়, এটি সামাজিক নৈতিকতার অবক্ষয়। চিকিৎসক, ওষুধ কোম্পানি, প্রশাসন—সবার মধ্যে নৈতিক শূন্যতা ভয়াবহভাবে বিস্তার লাভ করেছে। এই অবস্থার পরিবর্তন আনতে হলে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন এবং গণমাধ্যমকে এ বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। জনগণকে স্বাস্থ্যসেবার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে, যাতে তারা নিজেদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হন এবং প্রতারিত না হন।

সচেতনতা বাড়াতে ক্যাম্পেইন, প্রশিক্ষণ এবং গণমাধ্যমকে আরও সক্রিয় করতে হবে। ভোক্তা অধিকার সংস্থা, মানবাধিকার সংস্থা এবং মিডিয়াকে সমন্বিতভাবে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। শুধু সমালোচনা নয়, বাস্তবসম্মত সমাধান তুলে ধরে ন্যায়ভিত্তিক স্বাস্থ্যনীতি প্রতিষ্ঠায় গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। রাষ্ট্র, চিকিৎসক সমাজ, প্রশাসন, গণমাধ্যম এবং জনগণকে সম্মিলিতভাবে এই অসুস্থ অবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। এখন সময় এসেছে স্বাস্থ্যখাতে একটি শুদ্ধি অভিযান চালানোর, যেখানে দালাল নয়, নৈতিকতা, সহানুভূতি ও মানবিকতার চেতনা প্রতিষ্ঠিত হবে। এই নৈতিক অধঃপতনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এর মূল্য আরও ভয়ঙ্কর হতে পারে। আমাদের ডাক এখন—স্বাস্থ্যসেবা হবে মানবতার জন্য, মুনাফার জন্য নয়। আমাদের স্বপ্ন, আমাদের লড়াই—একটি মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য, যেখানে সুস্থতা হবে সবার অধিকার, কারও একচ্ছত্র ব্যবসা নয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, রংপুর

সারাবাংলা/এএসজি

মুক্তমত মোহাম্মদ নুর হোসেন নয়ন স্বাস্থ্যবাণিজ্য স্বাস্থ্যসেবা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর