একটা সময় ছিল, যখন মানুষ জন্ম বা মৃত্যু নিয়ে সরকারি কাগজপত্রের খুব একটা প্রয়োজন অনুভব করত না। কিন্তু এখনকার সময়টা একেবারেই ভিন্ন। আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামোয় একজন নাগরিকের পরিচয়ের প্রাথমিক ভিত্তি হচ্ছে জন্মনিবন্ধন সনদ। পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, জমি রেজিস্ট্রেশন কিংবা ব্যাংক হিসাব খোলা—সব কিছুতেই জন্মসনদ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। অথচ এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেবাটিই এখন সাধারণ মানুষের কাছে এক অসহ্য ভোগান্তির নাম।
জন্মনিবন্ধনের পথচলা
বাংলাদেশে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয় ‘জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন, ২০০৪’-এর মাধ্যমে। এরপর ২০০৬ সালের ৩ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে সারাদেশে জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম চালু হয়। শুরুর দিকে এটি কাগজে-কলমে হলেও পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত হয়। লক্ষ্য ছিল—প্রযুক্তির ব্যবহারে নাগরিকদের জীবন সহজতর করা। কিন্তু বাস্তব চিত্র ঠিক উল্টো।
বর্তমানে অনলাইনে জন্মনিবন্ধনের জন্য পুরনো সার্ভার থেকে নতুন সার্ভারে তথ্য স্থানান্তরের কাজ চলছে। এতে সিস্টেমে দেখা দিয়েছে কারিগরি জটিলতা। অনেকে অনলাইনে নিজের জন্মসনদ খুঁজে পাচ্ছেন না। কেউ ভুল তথ্য পেয়ে সংশোধনের জন্য ছোটাছুটি করছেন। আবার অনেকেই বাধ্য হয়ে দালাল ধরে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ে জন্মনিবন্ধন করাচ্ছেন।
১৭টি ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক জন্মসনদ: নাগরিক জীবনের প্রতিটি ধাপে অপরিহার্যতা _
বর্তমানে বাংলাদেশে নাগরিক সেবা গ্রহণের প্রায় প্রতিটি ধাপে জন্মনিবন্ধন সনদ একটি বাধ্যতামূলক দলিলে পরিণত হয়েছে। সরকারের প্রণীত নীতিমালার আওতায় মোট ১৭টি গুরুত্বপূর্ণ সেবাখাতে জন্মসনদ ছাড়া কোনোভাবেই সেবা পাওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে একজন নাগরিক জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে এই সনদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
পাসপোর্ট তৈরি: বিদেশ ভ্রমণ কিংবা প্রবাসে বসবাসের জন্য পাসপোর্ট আবশ্যক। জন্মসনদ ছাড়া বর্তমানে শিশুসহ কোনো বয়সের নাগরিকের পাসপোর্ট আবেদনই গ্রহণ করা হয় না।
জাতীয় পরিচয়পত্র (NID): ১৮ বছর বয়সে জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণের ক্ষেত্রে জন্মসনদই প্রাথমিক দলিল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সঠিক বয়স নির্ধারণ এবং নাগরিকত্ব প্রমাণে এটি অপরিহার্য।
বিয়ে ও তালাক নিবন্ধন: বিয়ে কিংবা তালাকের সময় নারীর ও পুরুষের বয়স যাচাই, পরিচয় নিশ্চিতকরণ এবং আইনগত সুরক্ষায় জন্মসনদ প্রয়োজন হয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি: প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রতিটি স্তরের ভর্তি প্রক্রিয়ায় এখন জন্মসনদ বাধ্যতামূলক। শিক্ষার্থীর বয়স, নামের সঠিকতা ও পরিচয়ের নিশ্চয়তায় এটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
চাকরিতে নিয়োগ: সরকারি ও বেসরকারি চাকরির আবেদন, বয়স যাচাই, পেনশন বা প্রভিডেন্ট ফান্ড সংক্রান্ত কার্যক্রমে জন্মসনদ প্রয়োজন হয়।
ড্রাইভিং লাইসেন্স: বয়স ১৮ পেরুলেই ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা যায়। বয়সের প্রমাণপত্র হিসেবে জন্মসনদ বাধ্যতামূলক।
জমি রেজিস্ট্রেশন: সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় বা হস্তান্তরের সময় ক্রেতা ও বিক্রেতার পরিচয় নির্ধারণ ও আইনগত বৈধতা রক্ষায় জন্মসনদ প্রয়োজন হয়।
ব্যাংক হিসাব খোলা: প্রায় সব ব্যাংকে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের একাউন্ট খোলার সময় বয়সের প্রমাণ হিসেবে জন্মসনদ চাওয়া হয়। এটি মানি লন্ডারিং রোধে সহায়ক দলিল হিসেবেও বিবেচিত।
আমদানি-রফতানি লাইসেন্স: ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে আমদানি ও রফতানির অনুমোদনের জন্য আবেদন করতে হলে আবেদনকারীর পরিচয় ও বয়স নিশ্চিত করতে জন্মসনদ লাগে।
গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, টেলিফোন সংযোগ: বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে এসব ইউটিলিটি সংযোগ নিতে জন্মসনদসহ অন্যান্য পরিচয়পত্র দরকার হয়। মালিকানা প্রমাণে এটি সহায়ক।
কর শনাক্তকরণ নম্বর (TIN): ব্যবসা বা চাকরির ক্ষেত্রে ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (TIN) নিতে বয়স ও পরিচয়ের প্রমাণ হিসেবে জন্মসনদ আবশ্যক।
ঠিকাদারি বা চুক্তির লাইসেন্স: সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক কাজ করতে হলে জন্মসনদসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হয়।
ট্রেড লাইসেন্স: ব্যবসার জন্য পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে জন্মসনদ চাওয়া হয়। এটি উদ্যোক্তার প্রাথমিক পরিচয় নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।
ভবন নকশার অনুমোদন: বাড়ি নির্মাণের জন্য সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার অনুমোদন নিতে আবেদনকারীর পরিচয় যাচাইয়ের জন্য জন্মসনদ প্রয়োজন।
মোটরযান নিবন্ধন: যানবাহনের মালিকানা নিবন্ধনের সময় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তথ্য নিশ্চিত করতে জন্মসনদ গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এই তালিকা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, একজন নাগরিকের জীবনের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়েই জন্মসনদ অপরিহার্য। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, এই অপরিহার্য সেবাটি গ্রহণ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে অসহনীয় ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে দালালচক্রের দ্বারস্থ হচ্ছেন অনেকে, বাড়তি খরচ গুণছেন, সময় অপচয় হচ্ছে, এমনকি আত্মসম্মানও ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তাই প্রশ্ন ওঠে– নাগরিকের জন্মের প্রমাণপত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে যদি তাকে বারবার প্রমাণ করতে হয়, সে আদৌ জন্মেছে কি না, তবে সেটাই কি সবচেয়ে বড় অবিচার নয়?
কারণ ও করণীয়: ভোগান্তির শেকড় আর সমাধানের সুনির্দিষ্ট পথ _
জন্মনিবন্ধন সনদ বর্তমানে যেমন একটি বাধ্যতামূলক দলিল, তেমনই এটি পেতে গিয়ে জনসাধারণ যে মাত্রার ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তা নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের মতোই উদ্বেগজনক। এই ভোগান্তির পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ—প্রাতিষ্ঠানিক, প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক।
ভোগান্তির মূল কারণগুলোর মধ্যে প্রধান তিনটি হলো _
জনবল সংকট: বহু ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে নিবন্ধন সহকারী বা প্রয়োজনীয় জনবল নেই। যেসব স্থানে আছেন, সেখানেও অতিরিক্ত কাজের চাপ ও স্পষ্ট দায়িত্ব বিভাজনের অভাবে কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষকে দিনের পর দিন ঘুরতে হচ্ছে শুধুমাত্র একটি সনদের জন্য।
কারিগরি দুর্বলতা: অনলাইন জন্মনিবন্ধন ব্যবস্থাটি পুরনো সার্ভার থেকে হালনাগাদকরণ প্রক্রিয়ায় রয়েছে, যা ধীরগতির ইন্টারনেট সংযোগ, নাজুক সার্ভার অবস্থা, তথ্যভাণ্ডারে ভুল বা অসম্পূর্ণতা এবং বারবার ত্রুটি দেখানোর মতো সমস্যায় ভুগছে। এসব প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকতা প্রতিটি ধাপে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করছে।
দায়িত্বশীলদের উদাসীনতা ও দুর্ব্যবস্থা: অনেক জায়গায় জন্মনিবন্ধনকে ‘গৌণ কাজ’ হিসেবে দেখা হয়। এর ফলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কার্যক্রমে আন্তরিক না হয়ে দাপ্তরিক দায়সারা ভাব নিয়ে কাজ করেন। এতে আবেদনকারীদের একাধিকবার অফিসে যেতে হয়, ঘুষ বা অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়, আর দালালচক্র সক্রিয় হয়ে উঠে।
এই বাস্তবতা থেকে উত্তরণে যেসব কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি _
কারিগরি দক্ষতা ও অবকাঠামো বৃদ্ধি: ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য যেমন উন্নত সার্ভার ও সফটওয়্যার প্রয়োজন, তেমনি ইউনিয়ন থেকে শুরু করে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে জন্মনিবন্ধন ব্যবস্থায় প্রযুক্তির মানোন্নয়ন জরুরি। দ্রুতগতির ইন্টারনেট, আপডেটেড সার্ভার, আধুনিক সফটওয়্যার এবং তথ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ ও কার্যকর তদারকি: জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী নিয়োগ করতে হবে। শুধু নিয়োগ নয়, তাদের কার্যক্রমের উপর নিয়মিত তদারকি ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ না থাকে।
দালালমুক্ত সেবা নিশ্চিতকরণ: সেবাগ্রহীতাদের দালালচক্রের কবল থেকে মুক্ত রাখতে হবে। প্রতিটি অফিসে ‘জন্মনিবন্ধন সহায়তা ডেস্ক’ চালু করে স্বচ্ছভাবে কাজ করা যায়। আবেদনকারীদের তথ্য যাচাই ও আপলোডসহ পুরো প্রক্রিয়ায় যেন কোনো বাড়তি অর্থ খরচ না হয়, তা নিশ্চিত করা দরকার।
সচেতনতা ও ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়ানো: অনেক মানুষ জানেন না কোথায় কীভাবে আবেদন করতে হবে, কোন কাগজ লাগবে, কত সময় লাগবে। ফলে ভুল তথ্য দিয়ে আবেদন জমা দেন বা দালালের দ্বারস্থ হন। গণমাধ্যম, স্থানীয় প্রশাসন ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাতে হবে।
উপযুক্ত মনিটরিং ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাপনা: জন্মনিবন্ধন ব্যবস্থাকে কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের জন্য একটি নির্দিষ্ট সেল থাকা জরুরি, যারা ইউনিয়ন পর্যায়ের কাজ নিয়মিত মনিটর করবে। একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাজের ওপর নির্ভর করে পুরস্কার-বিচার কাঠামো চালু করা যেতে পারে।
নাগরিক অধিকারে প্রযুক্তির আলোর স্নান
জন্মনিবন্ধন শুধু একটি কাগজ নয়, এটি একজন মানুষের রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের স্বীকৃতি এবং তার মৌলিক অধিকার। এই সনদ ছাড়া আজ একটি শিশুও নাগরিক সুবিধার বাইরে থেকে যাচ্ছে—যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। জন্মনিবন্ধন পেতে সাধারণ মানুষের যে ভোগান্তি, তা শুধু অনাকাঙ্ক্ষিত নয়, বরং একটি ডিজিটাল রাষ্ট্রের জন্য তা লজ্জারও।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ঘোষণার এত বছর পরও যদি নাগরিককে একটি মৌলিক সেবার জন্য দিনের পর দিন ঘুরতে হয়, দালালের দ্বারস্থ হতে হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠবেই—এই প্রযুক্তি আসলে কাদের জন্য? আমরা চাই, জন্মনিবন্ধন হোক সহজ, স্বচ্ছ, দ্রুত এবং দালালমুক্ত। হোক নাগরিকবান্ধব একটি উদাহরণ। এই পথে শুধু প্রযুক্তির আধুনিকীকরণই নয়, চাই প্রশাসনের আন্তরিকতা, কর্মীদের দক্ষতা, স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহির পরিবেশ। জন্মনিবন্ধন যেন হয় প্রতিটি শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে এক নিখুঁত ও নিশ্চিন্ত প্রাপ্তি। সেটাই হবে এক সত্যিকারের নাগরিক রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি।
লেখক: কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক