Wednesday 14 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উষ্ণতাবৃদ্ধি: আশঙ্কার সঙ্কেত

সফিউল ইসলাম
১৪ মে ২০২৫ ১৪:২১

বাংলাদেশ একটি জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশ হিসেবে ইতোমধ্যেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো পরিস্থিতির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে পরিবেশগত চ্যালেঞ্জটি আমাদের অস্তিত্বকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে, তা হলো উষ্ণতাবৃদ্ধি। ক্রমাগত গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও এর ফলস্বরূপ পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনীতি, জনস্বাস্থ্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিজ্ঞাপন

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে এটি আরও ১ থেকে ১.৫ ডিগ্রি বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। ২০২৪ সালে এই পরিবর্তনের বাস্তব রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি—দেশে তাপপ্রবাহের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। মে ২০২৩ থেকে মে ২০২৪ সময়কালে মোট ৭৬ দিন তীব্র তাপপ্রবাহ ছিল, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এই প্রবণতা প্রমাণ করে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন আর ভবিষ্যতের শঙ্কা নয়—এটি আমাদের বর্তমান বাস্তবতা।

বিজ্ঞাপন

উষ্ণতাবৃদ্ধি জনস্বাস্থ্যের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। উচ্চ তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে হিটস্ট্রোক, পানিশূন্যতা, হৃদরোগ ও শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যাগুলো বাড়ছে। শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য ঝুঁকি আরও বেশি। শহর ও গ্রামে গরমকাল এলেই হাসপাতালে গরমজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা চোখে পড়ার মতো বাড়ে। শুধু শারীরিক নয়, তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব মানসিক স্বাস্থ্যেও পড়ছে—ঘুমের ব্যাঘাত, দুশ্চিন্তা ও মনঃসংযোগে সমস্যা বাড়ছে, যার ফলে সমাজের সার্বিক উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হচ্ছে।

বাংলাদেশের কৃষি খাত উষ্ণতাবৃদ্ধির সরাসরি শিকার। উচ্চ তাপমাত্রা ফসলের বেড়ে ওঠার সময়কাল হ্রাস করে, ফলে ফসল পরিপক্ব হওয়ার আগেই ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ধান, গম, পাট, ভুট্টা ও শাকসবজির উৎপাদন কমে যাচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ২০২৩ সালে ধান উৎপাদন প্রায় ১৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। গরমে মৃত্তিকার আর্দ্রতা কমে যাওয়া, পানি বাষ্পীভবনের হার বেড়ে যাওয়া এবং জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ার কারণে কৃষকরা সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পানি পাচ্ছেন না। ফলে কৃষি খাত ক্রমশ ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করছে।

শুধু কৃষিই নয়, পানি সংকটও তীব্রভাবে সামনে আসছে। গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বাড়ার ফলে নদী-খাল শুকিয়ে যাচ্ছে এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে শহরাঞ্চলে গভীর নলকূপের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে ভূপৃষ্ঠের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। এই সংকট শুধু পানি সঙ্কোচনই ঘটাচ্ছে না, বরং ভবিষ্যতের জন্য এক ভয়ঙ্কর বিপদের বার্তা দিচ্ছে।

জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রেও উষ্ণতাবৃদ্ধি মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার থেকে শুরু করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরল প্রজাতির প্রাণী—সবাই আবাসস্থল হারাচ্ছে। জলাশয়ে মাছের মৃত্যু বেড়েছে, ডিম পারার হার কমেছে, এবং ফলস্বরূপ দেশের মৎস্যসম্পদ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। উদ্ভিদজগতেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে—গাছপালার মৃত্যুহার বাড়ছে এবং বনাঞ্চল সংকুচিত হচ্ছে। এই পরিবর্তন প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে একটি নেতিবাচক চক্র তৈরি করছে, যা পুরো ইকোসিস্টেমকে বিপর্যস্ত করছে।

শহরাঞ্চলে সমস্যার মাত্রা আরও বেশি। ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোতে হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট দেখা দিচ্ছে, যেখানে আশপাশের গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরের তাপমাত্রা বেশি থাকে। এর ফলে বাড়ছে বিদ্যুৎচাহিদা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রকের ওপর নির্ভরতা, এবং লোডশেডিং। আর এই অতিরিক্ত বিদ্যুৎচাহিদা মেটাতে ব্যবহৃত জ্বালানি পরিবেশে আরও বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করছে, ফলে উষ্ণতা আরও বাড়ছে। এই চক্র অব্যাহত থাকলে শহরগুলো আরও বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।

অর্থনীতির দিক থেকেও এই সংকট ভয়াবহ। আন্তর্জাতিক সংস্থা IFPRI-এর গবেষণায় দেখা গেছে, ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে ২০৮০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে তাপনির্ভর শ্রমশক্তির উৎপাদনশীলতা ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। ‘দ্য ল্যানসেট’-এর মতে, ২০২৩ সালে শুধু তাপঘটিত কারণে শ্রমঘণ্টা হ্রাস পাওয়ার ফলে বাংলাদেশ প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এই পরিসংখ্যানগুলো থেকে স্পষ্ট হয়, উষ্ণতাবৃদ্ধির ফলে শুধু মানুষ নয়, অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ আমাদের হাতেই। শুধু সরকার নয়, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণে একটি সমন্বিত উদ্যোগ গড়ে তুলতে হবে। পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন, বৃক্ষরোপণ, পানি ও বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়, এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সচেতনতা এই মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি। স্কুল-কলেজে পরিবেশ শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা, গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো এবং স্থানীয় সরকার পর্যায়ে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা নেওয়া সময়ের দাবি।

সরকারি নীতিমালায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন। শহর উন্নয়নে পরিবেশবান্ধব নকশা, কৃষিতে জলবায়ু-সহনশীল প্রযুক্তির ব্যবহার, এবং জলাভূমি সংরক্ষণে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে স্থানীয় প্রেক্ষাপটে উপযোগী সমাধান উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বাংলাদেশের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করতে হবে যাতে প্রয়োজনীয় অর্থ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পাওয়া যায়।

উষ্ণতাবৃদ্ধি একটি ধীরগতি সম্পন্ন বিপর্যয় হলেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এখনই যদি আমরা সজাগ না হই, তবে ভবিষ্যতের জন্য রেখে যাওয়া পৃথিবী হয়ে উঠবে আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, অনিরাপদ এবং অমানবিক। তাই সময়ের স্রোতে বিলীন হওয়ার আগেই আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে, সচেতন হতে হবে এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দিতেই এখন থেকেই পরিবেশ সংরক্ষণকে জীবনের অন্যতম অঙ্গ করে তুলতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ, ফেনী

সারাবাংলা/এএসজি

উষ্ণতাবৃদ্ধি মুক্তমত সফিউল ইসলাম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর