একবিংশ শতাব্দীর তথ্যপ্রবাহের যুগে আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক অদ্ভুত বাস্তবতায়-যেখানে গুজব হয়ে উঠেছে গণতন্ত্রের পরিপন্থী এক অস্ত্র এবং একই সঙ্গে অনেকের জন্য ‘মজার বিনোদন’। ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে ছড়ানো গুজব ও ভুয়া তথ্যের সংখ্যা ছিল ২৯৬টি। এর মধ্যে জাতীয় বিষয়ক গুজবই ১০১টি-মোট গুজবের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি। রাজনৈতিক ৪৫টি, ধর্মীয় ৩২টি, স্বাস্থ্য বিষয়ক ২৭টি, সামাজিক ইস্যু ৪৯টি।এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, আমরা এক বৈশ্বিক তথ্যযুদ্ধের মধ্যেই রয়েছি-যেখানে তথ্য একদিকে হতে পারে আলো, অন্যদিকে হতে পারে অন্ধকারের হাতিয়ার। এই সংখ্যাগুলি কেবল পরিসংখ্যান নয়, বরং সমাজে ক্রমবর্ধমান এক উদ্বেগজনক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। আমরা বসবাস করছি এমন এক যুগে, যেখানে সত্যের চেয়ে গুজব দ্রুত ছড়ায়, এবং মানুষ যাচাই না করেই মেনে নেয় সেটাকেই। যুগ বদলেছে, কিন্তু গুজবের প্রকৃতি বদলায়নি-বদলেছে এর বাহন। আগেকার দিনে পাড়ার চায়ের দোকানে, বাজারে বা হাটে বসে গুজব ছড়াতো মুখে মুখে। এখন সেটা ছড়ায় ‘ডিজিটাল হাওয়ায়’। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপ-সবই যেন গুজবের হাইওয়ে হয়ে উঠেছে।
তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে একটি গুজব মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই লক্ষ মানুষের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছে। ২০২৩ সালে ইউনেস্কোর এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ‘একটি গুজব সত্য তথ্যের তুলনায় ছয় গুণ দ্রুতগতিতে ছড়ায়’। এ পরিপ্রেক্ষিতে, আমরা বুঝতে পারি-এটি নিছক সামাজিক সমস্যা নয়, এটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এক ক্লিকে ছড়িয়ে পড়ছে অপসত্য, বিভ্রান্তি আর ভুয়া বার্তা। আর আশ্চর্যের বিষয় হলো, অনেকে দায় এড়ানোর জন্য বলেন- ‘আমি তো শুধু শেয়ার করেছিলাম!’ অথচ বাস্তবে এই ‘শেয়ার’ই হয়ে দাঁড়ায় ক্ষতির প্রধান মাধ্যম। রাষ্ট্র যখন গুজব দমনে কঠোর হওয়ার ঘোষণা দেয়, তখন দেখা যায়-যাদের আসলে জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার, তারা রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। বরং সত্য বলার অপরাধে নিরীহরাই হয়রানির শিকার হন। এই বিভ্রান্তির যুগে প্রশ্ন উঠছে-আমরা কি ‘গুজবতন্ত্রে’ বাস করছি? না, বরং এখন চলছে ‘গুগল-তন্ত্র’, যেখানে যাচাই-বাছাই ছাড়া যেকোনো তথ্য মিলছে, কিন্তু সত্যটা হারিয়ে যাচ্ছে ভিড়ে। তাই সময় এসেছে শিক্ষার পাঠ্যক্রমে যুক্ত করতে—’হোয়াটসঅ্যাপ মানেই সত্যি নয়’-এমন বোধগম্য বার্তা, যাতে নতুন প্রজন্ম গুজবের ফাঁদে না পড়ে, বরং তথ্যের সত্যতা যাচাই করে গড়ে তোলে সচেতন এক সমাজ।
এখন প্রশ্ন আসে-এই গুজবের জন্ম কোথায়? কেন এত তীব্রভাবে তা ছড়িয়ে পড়ে? গুজবের উৎপত্তি: অজ্ঞতা, অসৎ উদ্দেশ্য, না পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র? গুজব কখনো কখনো জন্ম নেয় সাধারণ মানুষের ভুল বোঝাবুঝি থেকে। কেউ একজন অসত্য শুনে বিশ্বাস করে, আরেকজনকে জানা-এভাবেই ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এর বাইরেও আছে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। রাজনৈতিক স্বার্থ, অর্থনৈতিক সুবিধা কিংবা কোনো একটি সম্প্রদায়কে বিপদে ফেলতেই অনেক সময় গুজব ছড়ানো হয়। আবার কখনো কেউ অর্থের আশায় ‘কনটেন্ট ভাইরাল’ করতে চায়-তখনো মিথ্যা গল্প তৈরি হয়। বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি, গুজব ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানো হয়েছে, ব্যাংকে হুড়োহুড়ি সৃষ্টি হয়েছে, গুজবে পিটিয়ে মানুষ মারা গেছে, এমনকি করোনার সময় গুজবে চিকিৎসাব্যবস্থা বিপন্ন হয়েছিল।
এগুলো দেখলেই বোঝা যায়, জাতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্তরেই বেশি আঘাত হানছে গুজব। সরকারের পদক্ষেপ, উপদেষ্টা/মন্ত্রীর বক্তব্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম-সবকিছুর মধ্যেই গুজবের ছায়া।
গুজবের ভয়াবহ প্রভাব-১. সামাজিক বিশৃঙ্খলা: একটি মিথ্যা ভিডিও বা ফেক নিউজ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করে দিতে পারে। ২. রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘœ: সেনাবাহিনী বা পুলিশ নিয়ে গুজব ছড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে দুর্বল করার চেষ্টা চলে। ৩. জনগণের আস্থাহীনতা: জনগণ রাষ্ট্রীয় তথ্যের প্রতি আস্থা হারায়, বিভ্রান্ত হয়। ৪. নৈতিক অবক্ষয়: শিক্ষার্থী বা তরুণ প্রজন্ম ভুল তথ্য নিয়ে গড়ে উঠলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে।
গুজবের প্রভাব সমাজ ও রাষ্ট্রে অস্থিরতা তৈরি করে। একটি মিথ্যা তথ্য শুধু একজন ব্যক্তিকে নয়, সম্পূর্ণ সমাজকে অস্থিতিশীল করতে পারে। ২০১২ সালে রামুর বৌদ্ধবিহার পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনার পেছনেও ছিল একটি ফেসবুকে পোস্টকৃত গুজব। ২০২১ সালে কুমিল্লার একটি পূজাম-পে কোরআন রাখা হয়েছে বলে গুজব রটানো হয়েছিল, যার জেরে সারাদেশে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা হয়। গুজব শুধু ক্ষতি করে না, মানুষের চিন্তাভাবনাকেও কলুষিত করে। ক্রমাগত মিথ্যা তথ্যের স্রোতে অনেকেই সত্য ও মিথ্যার ফারাক হারিয়ে ফেলেন। একে বলা হয় ‘ইনফোডেমিক’-তথ্যের অতিপ্রবাহ যেখানে সত্য লুপ্ত হয়ে যায়।
প্রশ্ন সামনে আসে-তথ্য যুদ্ধে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার ক্রাইম ইউনিট এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচেতনতামূলক কার্যক্রম থাকা সত্ত্বেও গুজবের লাগাম টানা যাচ্ছে না বলেই প্রতীয়মান হয়। প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে তথ্য প্রবাহ যেমন সহজতর হয়েছে, তেমনি মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে পড়াও হয়েছে পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি দ্রুত ও জটিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইউটিউব চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছে, যা জনমনে আতঙ্ক, বিভ্রান্তি এবং ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার আশঙ্কা তৈরি করছে। এ বাস্তবতায় প্রশ্ন ওঠে-কোথায় সেই কার্যকর ব্যবস্থা, যা সত্য-মিথ্যার ফারাক বুঝে প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ নিশ্চিত করবে? প্রয়োজন একটি শক্তিশালী তথ্য যাচাই কাঠামো, যা স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং প্রযুক্তিনির্ভর হবে। পাশাপাশি, গুজবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাধারণ মানুষের সচেতনতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল লিটারেসি এবং মিডিয়া শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি, এবং সংবাদপত্র ও বৈধ অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যে সমন্বয় জোরদার করা জরুরি। গুজব রোধ করতে গিয়ে যেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন না হয়—এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নীতিমালাতেও স্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা দরকার।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা গেছে, অনেক সময় প্রকৃত গুজব রটনাকারী বা তাদের পেছনের সংগঠিত চক্রকে শনাক্ত ও দমন না করে বরং মতপ্রকাশকারী নিরীহ ব্যক্তি, এমনকি গবেষক, সাংবাদিক কিংবা সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধেই আইন প্রয়োগ করা হয়। এ ধরনের ঘটনা শুধু গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে না, বরং সমাজে এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে যেখানে সত্য বলা বা তথ্যভিত্তিক মতামত প্রকাশ করাই হয়ে দাঁড়ায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। ফলে গুজব নির্মূলের বদলে সত্য কথাকে দমন করার প্রবণতা বাড়ে, যা গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার জন্য অশনি সংকেত।
গুজব প্রতিরোধে করণীয় কী? গুজব নির্মূলে সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো-সচেতনতা বৃদ্ধি। গণমাধ্যম, স্কুল-কলেজ ও সামাজিক সংগঠনগুলোর উচিত তথ্য যাচাইয়ের শিক্ষা দেওয়া। স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে তথ্য যাচাই (Fact-Checking) ও মিডিয়া সাক্ষরতা (Media Literacy) অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সরকারিভাবেও একটি স্বাধীন ও বিশ্বাসযোগ্য ফ্যাক্ট-চেকিং সেল গঠন করা যেতে পারে, যেটি গুজব ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানাবে। এছাড়াও- ১. সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। তাদের অ্যালগরিদম যাতে মিথ্যা তথ্যকে প্রশ্রয় না দেয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। ২. আইনের প্রয়োগ হতে হবে সুনির্দিষ্ট ও স্বচ্ছ। সমালোচক নয়, গুজব রটনাকারীরা হোক আইনের প্রধান লক্ষ্য। ৩. বিশ্বস্ত মিডিয়া ও সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে, যাতে তারা প্রকৃত সত্য তুলে ধরতে পারে। ৪. কমিউনিটি লিডারদের সম্পৃক্ত করে স্থানীয় পর্যায়ে গুজব প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা যেতে পারে। ৫. দ্রুত প্রতিবাদ ও ব্যাখ্যা: সরকার বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো গুজব ছড়ালে তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ ও প্রকৃত তথ্য প্রকাশ জরুরি। ৬. সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ: সাংবাদিক, শিক্ষক, ধর্মীয় নেতা, ইউটিউবার—এদের তথ্য বিশ্লেষণ ও যাচাইয়ের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
বাংলাদেশ আজ এক অদৃশ্য যুদ্ধের সম্মুখীন—এটি সত্য ও অসত্যের, তথ্য ও গুজবের, বিশ্বাস ও বিভ্রান্তির যুদ্ধ। রিউমার স্ক্যানার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, গুজব আর নিছক গালগল্প নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নিরাপত্তার বিরাট চ্যালেঞ্জ। এখন সময় সত্যের পক্ষে দাঁড়াবার, তথ্য যাচাইয়ের সংস্কৃতি গড়ে তোলার, এবং গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স প্রদর্শনের। না হলে আগামী দিনে আমরা শুধু বিভ্রান্ত মানুষ নয়, বিভ্রান্ত জাতি হয়ে পড়ব।
গুজব নয়, আমরা চাই সত্যের সাহসিকতা। আমরা যদি সত্যিই আধুনিক, তথ্যনির্ভর ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গড়তে চাই, তবে শুধু উন্নয়নের বুলি নয়-সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা, তথ্যের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভুয়া তথ্যের বিরুদ্ধে সম্মিলিত অবস্থান নিতে হবে। কারণ গুজবের বিরুদ্ধে লড়াইটা কেবল সরকারের নয়, বরং আমাদের সবার। একজন শিক্ষক যেমন শ্রেণিকক্ষে, একজন ইউটিউবার যেমন ভিডিওতে, তেমনি একজন লেখক বা নাগরিকও কলমে কিংবা সামাজিক মাধ্যমে গুজবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেন। প্রযুক্তির এই যুগে তথ্য সবচেয়ে বড় শক্তি—আর সেই শক্তিকে যদি গুজব বিষিয়ে তোলে, তাহলে অন্ধকারে তলিয়ে যাবে সমাজ। আমরা চাই, সত্যই জিতুক, তথ্যই বলুক ভবিষ্যতের পথ।
শেষে বলি- সত্যকে খুঁজে নিতে হয়-বেশি শেয়ার করা মানেই সত্য নয়। আজকালকার দিনে গুজব একধরনের গণঅভ্যাস, যেটা মুছতে হলে দরকার শিক্ষা, সচেতনতা। গুজব কখনো একা আসে না, সঙ্গে নিয়ে আসে আতঙ্ক, বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাস। আর একবার যদি সত্যি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তাহলে সমাজ অন্ধকারে তলিয়ে যায়। তাই প্রয়োজন ‘সতর্ক পাঠক’, ‘সচেতন ব্যবহারকারী’ এবং একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট