বাংলাদেশের নদী আমাদের জীবন, সংস্কৃতি, কৃষি, এবং অর্থনীতির অঙ্গ। নদী ছাড়া বাংলাদেশের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। বাংলাদেশ মূলত নদীবিধৌত দেশ এবং দেশের সব মানুষের জীবনে নদীর প্রভাব অসীম। তবে আজ নদীসমূহ ক্রমশ মরে যাচ্ছে, যা দেশের জনজীবন, পরিবেশ, এবং কৃষির জন্য মহা বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৬ মে ‘ফারাক্কা লং মার্চ দিবস’ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে নদী রক্ষার এই লড়াই শুধু পরিবেশগত নয়, এটি একটি অস্তিত্বের প্রশ্ন। প্রায় ৫০ বছর আগে বাংলার সাধারণ জনগণ ফারাক্কার বিরুদ্ধে লং মার্চ করেছিল, সেই স্মৃতি আজো আমাদেরকে নদী রক্ষার অনুশাসন মনে করিয়ে দেয়। ফারাক্কা বাঁধ, যার ফলে পদ্মা নদীর প্রবাহে বিরাট ক্ষতি সাধিত হয়েছে, তার ক্ষত আজও শুচিক্রমের মতো অনুভূত হচ্ছে।
ফারাক্কার কারণে পদ্মা নদীর প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় সারা দেশের নদীজুড়ে বিশাল প্রভাব পড়েছে। বন্যার প্রকোপ, নদীভাঙন, খাল-বিলের শুকিয়ে যাওয়া, এবং গঙ্গা-যমুনা, তিস্তা নদীর অস্থিত্বের হুমকি আজ আমাদের জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—এই নদীহীন পৃথিবীতে আমাদের কী অবস্থান হবে? কিভাবে আমরা এই পরিবেশগত ও জীবনধারার বিপর্যয়ের মোকাবিলা করব?
ফারাক্কার ফাঁদ: বৈষম্যমূলক উন্নয়নের প্রতীক
ফারাক্কা বাঁধটি কেবলমাত্র একটি অবকাঠামো নয়, এটি ভারতের উন্নয়ন কৌশলের এক গভীর রাজনৈতিক পরিকল্পনার ফলাফল। পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী নদীকে বাঁচানোর জন্য, ভারত ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করে পদ্মার প্রবাহ একেবারে আটকিয়ে দিয়েছে, যা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জলবায়ু ও কৃষির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। ভারত একতরফাভাবে এই নদীর পানি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়, যা বাংলাদেশের জন্য বিরাট বিপর্যয় ডেকে আনে। কিন্তু ফারাক্কার ক্ষতিকারক প্রভাব শুধু বাংলাদেশের সীমান্তেই থেমে নেই, এটি প্রতিবেশী দেশগুলোতে এর প্রভাব ফেলছে।
বিশ্বের বহু নদী উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে ফারাক্কা অন্যতম, যা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে একতরফাভাবে পানি ব্যবহারের জন্য বানানো হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি এর ক্ষতিকর প্রভাব শুধু পরিবেশগত নয়, বরং এই অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এবং রাজনৈতিক ঐতিহ্যকেও ধ্বংস করেছে।
তিস্তা: ফারাক্কার নব রূপ
বর্তমানে, ফারাক্কার চাইতে তিস্তা বাঁধ বাংলাদেশের জন্য আরও বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিস্তা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী, যা কৃষি, পরিবেশ, এবং জীবনযাত্রার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে তিস্তা এখন বছরের অধিকাংশ সময় খালের মতো শুকিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রামসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষকদের জন্য বিপদ আসন্ন। তিস্তার পানি কমে যাওয়ার কারণে চাষাবাদ বিপর্যস্ত, এবং মাছের উৎপাদনও ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এতে কৃষকদের জীবিকা প্রায় ধ্বংসের মুখে।
যদিও তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে অনেকবার আলোচনা হয়েছে, তবে চুক্তি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলাদেশের কূটনৈতিক শোচনীয় অবস্থান এবং ভারতের একতরফা পানি ব্যবহারের কারণে এই ইস্যু রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক জটিলতায় আটকে গেছে। তিস্তা এবং ফারাক্কার মধ্যকার সম্পর্কের ইতিহাস বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জলকূটনীতি: বাংলাদেশের নতজানু নীতির পরিণতি
বাংলাদেশের জলসম্পদ নীতির দুর্বলতা আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতাকে বড় একটি চ্যালেঞ্জে পরিণত করেছে। সরকার অনেকবার নিজেদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্বার্থে পানির ন্যায়বিচার থেকে সরেছে, যা নদী রক্ষার আন্দোলনকে অনেকটা দুর্বল করেছে। আমাদের নদী রক্ষার আন্দোলনকে কখনোই সরকার, কখনোবা রাজনৈতিক স্বার্থের শিকার হতে হয়েছে। ভারতের সীমান্তে বাংলাদেশকে সহযোগিতা প্রদান, বাণিজ্য চুক্তি ইত্যাদি নানা কারণে নদী বিষয়ক সমস্যা পেছনে চলে গেছে।
এটি বাংলাদেশের একটি বড় কূটনৈতিক দুর্বলতা, যেখানে একতরফাভাবে ভারতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশের মানুষ নদী এবং জলসম্পদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যে যুদ্ধে আমাদের নদীগুলি হারিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমাদের সরকারও অনেক সময় নিরব থেকে সমস্যার সমাধান করতে পারছে না।
নদী হত্যার পেছনে অর্থনীতি ও ক্ষমতার রাজনীতি
নদী হত্যার কারণ শুধু আন্তর্জাতিক আগ্রাসন নয়, এর পেছনে রয়েছে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা। নদী দখল, অবৈধ বালু উত্তোলন, নদীভাঙন, দূষণ—এসব বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা প্রকাশ করে। এইসব সমস্যাগুলির ফলে নদীগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে, ক্ষমতাবান গোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিরা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের বিরুদ্ধে কাজ করছেন, যা তাদের ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত।
আমাদের নদীসমূহ ধ্বংসের পেছনে এটি একটি গভীর অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে, যা দেশের নদী ব্যবস্থাপনাকে দুর্বল করে দিয়েছে। নদী দখলকারীরা, যারা ক্ষমতাশালী, তারা নদী হত্যা থেকে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে।
নতুন মুক্তির কৌশল: জনগণের পক্ষ থেকে জলযুদ্ধের ডাক
এখন সময় এসেছে নদী রক্ষার আন্দোলনকে শুধু সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে এসে জনগণের হাতে তুলে নেয়ার। ১৯৭৬ সালে ফারাক্কার বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত লং মার্চের মতো, এখন আবার জনগণকে সামনে আনা প্রয়োজন। জনগণের চাপ ও আন্দোলনই কেবল সরকারের নতজানু নীতি বদলাতে সক্ষম। নদী রক্ষায় সবাইকে একত্রিত হতে হবে, বিশেষ করে তরুণদেরকে আন্দোলনে যোগ দিতে হবে।
ফারাক্কা দিবসকে কেবল স্মৃতিচারণ হিসেবে না দেখে, প্রতিবাদ ও আন্দোলনের দিন হিসেবে পালন করা উচিত। সারা বিশ্বে নদী রক্ষার জন্য প্রতিবাদ এবং প্রচারণা চালাতে হবে, যাতে আমাদের দাবি আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছায়। তিস্তা চুক্তি ও অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগির ক্ষেত্রে আরও জোরালো দাবি জানাতে হবে। নদী আন্দোলনকে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে এবং প্রশাসনকে নদী দখল ও দূষণ থেকে মুক্ত করার জন্য কাজ করতে হবে।
ফারাক্কা দিবস শুধু অতীতের স্মৃতি নয়, এটি একটি নতুন লড়াইয়ের প্রতীক। যদি এখনই আমরা নদী রক্ষার জন্য না সোচ্চার হই, তবে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, এবং জীবনযাত্রার বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। এটি কোনো একক দেশের সমস্যা নয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক সংকট হয়ে দাঁড়াবে। নদী রক্ষায় আমাদের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সরকার এবং আন্তর্জাতিক মহলকে একসাথে কাজ করতে হবে। ফারাক্কা দিবস হোক নদী রক্ষার নতুন শপথের দিন।
লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, রংপুর