Saturday 17 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাজেট ভাবনা ২০২৫-২৬
রাজস্ব আয় বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করনীয়

ড. মিহির কুমার রায়
১৭ মে ২০২৫ ১৬:৩০

বর্তমানে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বেশ কয়েকটি সূচক সন্তোষজনক অবস্থায় নেই। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে রাজস্ব আদায় পৃথিবীর অন্যতম সর্বনিম্ন (৮.৫%) , এছাড়া আছে ব্যাংক খাতের উচ্চ খেলাপি ঋণ (২০%), বাড়ছে মূল্যস্ফীতি (১০.৭%) এবং দেশ থেকে বিভিন্নভাবে অর্থ পাচারসহ বিনিয়োগ বাড়ছে না। এ অবস্থায় আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ রাজস্ব আয় বাড়ানো। কারন রাজস্ব আহরণে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না হওয়া এবং বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান কমে যাওয়ার কারণে আগামী বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) এর আকার কমছে। এবার এডিপি’র আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর এখাতে বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। বরাদ্দের দিক থেকে আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। তবে এডিপি’র আকার কমলেও পরিচালন বা অনুন্নয়ন খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। নতুন অর্থবছরের বাজেটে এ খাতের ব্যয় ধরা হতে পারে ৫ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। এদিকে বাজেট ও এডিপি’র আকার কমলেও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে। আগামী বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর আওতাধীন ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে। চলতি বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের মূল লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যেই এটি কমিয়ে সংশোধন করে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

প্রাপ্ত তথ্য মতে, মূল বাজেটে ঘোষিত ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ১ লাখ ৫৯ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এটি লক্ষ্যমাত্রার ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে মোট রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। রাজস্ব প্রবৃদ্ধির হার হচ্ছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। এছাড়া এনবিআর-বহির্ভূত খাত থেকে ৩ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা (লক্ষ্যমাত্রার ২৫ শতাংশ) এবং কর-বহির্ভূত রাজস্ব খাত থেকে ৩২ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা (লক্ষ্যমাত্রার ৭০.৬ শতাংশ) আদায় হয়েছে। এনবিআর আওতাধীন রাজস্ব আদায়ের উপখাতগুলোর মধ্যে চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে আয়কর উপখাতে ৫২ হাজার ৫ কোটি টাকা (লক্ষ্যমাত্রার ২৯.৬%); ভ্যাট উপখাতে ৬৩ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা (লক্ষ্যমাত্রার ৩৪.৭%); সম্পূরক শুল্ক উপখাতে ২২ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা (লক্ষ্যমাত্রার ৩৫.২%); আমদানি শুল্ক উপখাতে ১৮ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা (লক্ষ্যমাত্রার ৩৮%); এক্সাইজ উপখাতে ১ হাজার ২০৭ কোটি টাকা (লক্ষ্যমাত্রার ২০.৮%); এবং অন্যান্য খাতে ১ হাজার ১১৩ কোটি টাকা (লক্ষ্যমাত্রার ৫৬.২%) রাজস্ব আদায় হয়েছে। এছাড়া রফতানি শুল্ক উপখাতে মোট ৭০ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ছয় মাসে এ উপখাতে কোন রাজস্ব বাড়েনি । বর্তমান আর্থিক বছর শেষ হতে আর একমাসেরও বেশি সময় থাকলেও রাজস্ব আদায় সন্তোস জনক হবে তা বলা যাবে না।

বিজ্ঞাপন

সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত করে ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ নামে নতুন দুটি বিভাগ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ।গত ১২ই মে রাতে এ সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। নতুন অধ্যাদেশ অনুযায়ী, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগটি শুল্ক-কর আদায়ের কাজ করবে। আর রাজস্ব নীতি বিভাগ শুল্ক-কর হার বৃদ্ধি বা কমানোর বিষয়টি ঠিক করবে। দুই বিভাগই অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতায় কাজ করবে।অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, দুটি বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর এনবিআরের বিদ্যমান জনবল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে ন্যস্ত হবে। তবে এসব জনবল হতে প্রয়োজনীয় জনবল রাজস্ব নীতি বিভাগেও পদায়ন করা যাবে।এদিকে অর্থনীতিবিদরা রাজস্ব খাতের এই বড় সংস্কারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা মনে করেন, এই সংস্কারের ফলে কর প্রশাসনের আধুনিকীকরণ, রাজস্ব বৃদ্ধি ও ব্যবস্থাপনা আরও দক্ষ হবে। অন্যদিকে, এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তারা মনে করেন, এই সংস্কারের ফলে রাজস্ব খাতে প্রশাসন ক্যাডারের আধিপত্য বাড়তে পারে। সীমিত হতে পারে শুল্ক-কর কর্মকর্তাদের সুযোগ। বিশ্বের সব দেশেই রাজস্ব নীতি ও বাস্তবায়ন বিভাগ পৃথক। যারা নীতি প্রণয়ন করবেন, তাদের পেশাদার হতে হবে। অর্থাৎ দেশের জিডিপি, অর্থনীতি, পরিসংখ্যান- এসব বিষয়ে ধারণা থাকতে হবে। যারা নীতি প্রণয়ন করবেন, তারা আবার রাজস্ব সংগ্রহও করবেন, তা হতে পারে না। এই সিদ্ধান্ত সাহসী ও সময়োপযোগী। এই সংস্কারের ফলে বাংলাদেশের কর প্রশাসনের আধুনিকীকরণ, রাজস্ব বৃদ্ধি ও ব্যবস্থাপনা আরও দক্ষ হবে। সামগ্রিক করব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কারের মাধ্যমে জনসংখ্যার ধনী অংশ, যারা সঠিকভাবে কর দেয় না, তাদের করের আওতায় আনতে হবে। এনবিআর বিলুপ্তির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে এনবিআর রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত মাত্র ৮ দশমিক ৫ শতাংশ; এটি এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। কর-জিডিপির অনুপাত বাড়াতে এনবিআর পুনর্গঠন জরুরি। একই সংস্থা করনীতি প্রণয়ন এবং সেই নীতির বাস্তবায়ন করবে- এ অবস্থান সাংঘর্ষিক।

এই নতুন নীতিমালা নিয়ে এনবিআর এর কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের মাঝে অসন্তোস রয়েছে । সে যাই হউক না কেন এই সংন্থাটি রাজস্ব আহরনের ক্ষেত্রে সফলতা দেখাতে পারেনি । যে কোন সঙ্কার এর ফল পেতে অনেকটা সময় লাগবে এবং আসন্য যে সকল চ্যালেঞ্জ অতি নিকটবর্তি যা সমাধানের ইদ্যোগ নিতে হবে তা হলো :১. ঋণ না নিয়ে কীভাবে রাজস্ব আহরণের মাধ্যমে বাড়তি ব্যয় মেটানো যায়, সেটি সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ। ব্যয়ের ক্ষেত্রেও অনেক সমস্যা আছে। ফলে সরকারি অর্থ ব্যবহারের জন্য যেসব প্রতিষ্ঠানের ওপর দায়িত্ব আছে, ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের জবাবহিদিতার আওতায় আনতে হবে। এর ফলে বরাদ্দকৃত অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত হবে। ঘাটতি মোকাবিলায় ব্যাংকের ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। কারণ সরকারি বাজেট বাস্তবায়নে ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমে যাবে। এতে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর ফলে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে;২. রাজস্ব বাড়ানোর জন্য অবশ্যই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এজন্য বর্তমান করদাতাদের ওপর চাপ না বাড়িয়ে নতুন করদাতা শনাক্ত করা জরুরি। তাদের কর নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে হবে। অর্থাৎ করের হার না বাড়িয়ে আওতা বাড়াতে হবে। অন্যদিকে কর ফাঁকি রয়েছে। যেমন ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে অনেক দোকানদার রসিদ দেয় না। তারা টাকা আদায় করলেও সরকারের কোষাগারে জমা দেয় না। আয়করের ক্ষেত্রে যাদের টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) যাদের আছে, আয়কর রিটার্ন জমা দেয় তার অর্ধেক। বাকি অর্ধেককে কেন পাওয়া যাচ্ছে না, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। ফলে আমাদের করদাতা বাড়ানো জরুরি। তবে এক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের দক্ষতার অভাব, না তারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সেটি ভেবে দেখা দরকার; ৩. আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে সাম্প্রতিক সময়ে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যা হলো রাজস্ব নীতি ও প্রশাসন আলাদা করেছে। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে এই পদ্ধতি আছে। কিন্তু এটি বাংলাদেশের জন্য কতটা উপযোগী হবে, তা নিয়ে আরও আলোচনা হওয়া উচিত। অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনরা এ বিষয়ে তাদের মতামত তুলে ধরবে। সেই মতামতের আলোকে সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। তবে আর্থিক খাতে নিঃসন্দেহে সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। কারণ অর্থনীতিতে বড় সমস্যা হলো খেলাপি ঋণ। এটি ক্রমেই বাড়ছে; ৪. রাজস্ব আয়বৃদ্ধির লক্ষ্যে করনীয়দের মধ্যে অন্যতম হলোমূসক সংস্কার, অপ্রদর্শিত অর্থের বৈধকরন নীতি,সীমান্ত ও কাষ্টম আধুনিকায়ন , উন্নয়ন প্রকল্পে কর অব্যাহতি পর্যালোচনা,,খাতভিত্তিক করকাঠাসো পুনর্মূল্যায়ন ইত্যাদি ; ৫.দেশ থেকে নানাভাবে অর্থ পাচার হয়েছে। এর মধ্যে আমদানিতে মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং) এবং রপ্তানিতে পণ্যমূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং) অন্যতম। বৈশ্বিক সংস্থা জিএফআইর (গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি) রিপোর্টে বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্যের আড়ালে টাকা পাচারের কথা বলা হয়েছে। এগুলো চিহ্নিত করা খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। কারণ কোন পণ্যের কী দাম তা অনলাইনের মাধ্যমে জানা যায়। ফলে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে যে ঘোষণা দেওয়া হয়, তা বাস্তবসম্মত কিনা চিহ্নিত করা যায়। তবে একবার বিদেশে টাকা গেলে তা আদায় করা কঠিন। সবকিছু মিলে বাজেটে এ ব্যাপারে একটি দিকনির্দেশনা থাকা উচিত; ৬.গত কয়েকটি বাজেটেও সরকার সংস্কারের অঙ্গীকার করেছে। শর্তগুলো বাস্তবায়নের জন্য বাড়তি রাজস্ব আহরণের প্রস্তব বাজেটের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হতে পারে।এ জন্য শক্ত উদ্যোগ নিলে বাড়তি রাজস্ব আদায় সম্ভব। আর এনবিআরকে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে আরও দক্ষ হতে হবে। সরকার ও সমাজের প্রতিটি অংশের তাদের কাছে প্রাপ্য কর ও ফি পরিশোধে পুরোপুরি অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। কর ও ভ্যাট সম্পর্কিত সব বকেয়া মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ভালো আইনজীবী নিয়োগ এবং অনানুষ্ঠানিক মামলা নিষ্পত্তি বা এডিআর কার্যক্রম নিষ্ঠার সঙ্গে পরিচালনা করতে হবে।এবার বাজেটকে অধিকতর অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে অর্থ বিভাগের ওয়েবসাইট এ বাজেটের সব তথ্যাদি ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পাঠ ও ডাউনলোড করতে পারবেন।এছাড়া দেশ বা বিদেশ থেকে ওই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ফিডব্যাক ফর্ম পূরণ করে বাজেট সম্পর্কে মতামত ও সুপারিশ প্রেরণ করা যাবে। প্রাপ্ত সব মতামত ও সুপারিশ বিবেচনা করা হবে। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বাজেট অনুমোদনের সময়ে এবং পরে তা কার্যকর করা হবে। ব্যাপকভিত্তিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি ওয়েবসাইট লিংকের ঠিকানাগুলোয়ও বাজেট সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যাবে যা একটি আধুনিক উদ্যোগ।

লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সাবেক ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি, ঢাকা ও সাবেক জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবীদ সমিতি, ঢাকা

সারাবাংলা/এএসজি

ড. মিহির কুমার রায় মুক্তমত রাজস্ব আয়

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর