১৯৭৬ সালের ১৬ মে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ভারতের ফারাক্কা ব্যারেজ প্রকল্প নির্মাণের প্রতিবাদে এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে পদ্মা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে লাখো জনতা নিয়ে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ করেন। সেই থেকে ১৬মে দিনটি ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস পালিত হয়ে আসছে। ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের মতো ভাটির দেশের জন্য অভিশাপ। হিমালয় থেকে উৎপত্তি হয়ে বিভিন্ন নদী চীন ও ভারত হয়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। ভারতের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া আন্তসীমান্ত ও আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশের কথা না ভেবে ভারত নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার ফলে ঘটেছে মূল বিপত্তি। আর বাংলাদেশের জন্য এই বিপত্তির নাম ফারাক্কা বাঁধ। ভারত এই বাঁধ নির্মাণ করে ১৯৭৫ সালে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় গঙ্গা নদীর ওপর এই বাঁধ অবস্থিত। ১৯৬১ সালে এই বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৯৭১ সালে। চালু করা ১৯৭৫ সালে। বাংলাদেশের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ১৮ কিলোমিটার উজানে ফারাক্কা বাঁধের অবস্থান। এই বাঁধ নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল গঙ্গার পানিকে হুগলি নদীর দিকে স্থানান্তরিত করে কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বজায় রাখা। ফারাক্কা বাঁধ করার সময় সমালোচনা গায়ে মাখেনি ভারত। কলকাতা বন্দর, কলকাতা শহর ও তখনকার সময়ে নদীর যে ইকোসিস্টেম তৈরি হয়ে গিয়েছিল সে বিবেচনায় তাতে ফারাক্কা ব্যারেজ প্রকল্পকে তারা সবচেয়ে ভালো সমাধান বলে মনে করেছিল।
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের পর থেকেই ফারাক্কা বাঁধের পরিকল্পনা শুরু হয়। বাঁধ চালু হবার পর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশে। শুষ্ক মৌসুমে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নদনদী শুকিয়ে যেতে থাকে।
বাংলাদেশের পানি প্রাপ্তির ন্যায়সঙ্গত অধিকার নিয়ে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে’র লংমার্চ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশ সাড়া ফেলেছিল। পানির অধিকার প্রশ্নে এত বড় লংমার্চ বাংলাদেশে তো বটেই ভারতীয় উপমহাদেশে আগে কখনো হয়নি। যদিও গঙ্গার পানি বন্টন নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয় ১৯৫২ সাল থেকে। কিন্তু গঙ্গার পানি বন্টন নিয়ে বাঁধ করার আগ পর্যন্ত এসব আলোচনার তোয়াক্কা না করে ভারত তার মতো কাজ করে গেছে। যার শেষ পরিণতি ফারাক্কা বাঁধ।
পদ্মা নদীর উজানে ভারতের গঙ্গায় ফারাক্কা ব্যারেজ বাংলাদেশের প্রকৃতি-প্রতিবেশ ব্যবস্থায় বড় ক্ষতি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের নদনদীগুলো ফারাক্কার প্রভাবে শুকিয়ে গেছে। নদীকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকা, নদী রক্ষা ও জীববৈচিত্র্যের উপর ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। নদনদীগুলো শুকিয়ে মরার মতো ধুঁকছে। কৃষিকাজে পানির অভাবে ফলস উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটছে। অনেকে তাদের নদীকেন্দ্রিক জীবিকার পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। পানির অভাবে পদ্মার শাখা নদীগুলোও মৃতপ্রায়। রাজশাহী ও নাটোরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া বড়াল নদীর উৎসমুখ মৃতপ্রায়। কুষ্টিয়ার গড়াই নদী পানির অভাবে প্রাণ হারিয়েছে। পদ্মার বহু শাখানদী পলি পড়ে ভরাট হয়ে চলার শক্তি হারিয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের ‘গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প’ পদ্মার পানির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে প্রকল্পের কয়েকটি জেলার সেচ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছে। তিস্তা নদী খাঁ খাঁ করছে পানির অভাবে। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীকেন্দ্রিক সেচ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছে। পানির অভাবে মাথাভাঙ্গা, কুমার নদীরও চলার শক্তি নেই।
বর্ষা মৌসুমে ঠিক এর বিপরীত অবস্থা দেখা যায়। বর্ষা মৌসুমে ভারত তার অতিরিক্ত পানি বাঁধ দিয়ে ছেড়ে দেয়। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পানি বঙ্পোপসাগরের দিকে যাত্রা শুরু করে। দেখা দেয় বন্যা। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে বন্যার ঝুঁকি তৈরি হয় ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে অতিরিক্ত পানি ছাড়ার কারণে। ভারত ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে পানি ব্যবস্থা নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করে। শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে রেখে নিজেদের কৃষিতে সেচসহ বিভিন্ন কাজে লাগায় ভারত। অপরদিকে নিজেরা বন্যার হাত থেকে বাঁচতে বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয়। ভারত শুধু নিজেদের কথা একতরফাভাবে চিন্তা করে। শুষ্ক মৌসুমে পানি না পেয়ে বাংলাদেশের কৃষি ও প্রতিবেশ ব্যবস্থায় যে কী ক্ষতি হচ্ছে কিংবা বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানির কারণে কী ক্ষতি হচ্ছে; সে বিষয়ে ভাবে না। বাংলাদেশের আপত্তিটা মূলত এখানেই। আন্তসীমান্ত নদীর পানি ব্যবস্থাপনায় নদীর ন্যায্য হিস্যা বিষয়ে চুক্তি করার বিধান রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলাদেশ-ভারতের ৫৪ টি আন্তঃনদী থাকলেও চুক্তি রয়েছে কেবল গঙ্গার পানি বন্টন নিয়ে। গঙ্গা পানি বন্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৯৬ সালে। ৩০ বছরের এ চুক্তি ২০২৬ সালে শেষ হচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে প্রতিবছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৩৫ হা্জার কিউসেক পানি দেবে ভারত। কিন্তু সে কথাও বিভিন্ন সময়ে রাখা যায়নি। শুষ্ক মৌসুমে প্রত্যাশার চেয়ে কম পানি পেয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে ন্যায্য পানি প্রাপ্তির জন্য ভারতের কাছে দাবি জানিয়েছে।
পৃথিবীর তৃতীয় বৃহৎ নদী অববাহিকা হলো হলো গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা (জিবিএম) নদী অববাহিকা। বাংলাদেশ ছাড়াও এ অববাহিকায় আরও চারটি দেশ হলো চীন, ভারত, নেপাল ও ভুটান। এসব দেশের মধ্যে পানি নিয়ে বিভিন্ন সময়ের বিরোধ নতুন কোনো ঘটনা নয়। ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল- এটা সব দেশ জানে। আর এটাকেই যেন টার্গেট করে অন্য দেশগুলো। শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য হাহাকার আর বর্ষায় বন্যায় ভেসে যাওয়া- এটা কোনো দেশের জন্য অমোঘ বাস্তবতা হতে পারে না!
২০২১ সালে অন্যান্য নদী যেমন ফেনী, মনু, গোমতী, ধরলা, দুধকুমার, মুহুরি, খোয়াইসহ বিভিন্ন নদীর পানি প্রাপ্তির নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হলেও পরে তা আলোর মুখ দেখেনি। এছাড়া বিভিন্ন সময় তিস্তাসহ বিভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা হলেও সেসব আলোচনা বেশিদূর এগোইনি। ফারাক্কা বাঁধের আগে অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের আগে বাংলাদেশকে পানি নিয়ে এতটা ভাবতে হয়নি। পানি না থাকলে নদী বাঁচে না। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। সে হিসেবে পানি না পেলে নদীমাতৃক ও কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের অবস্থা কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। ভারতের অনেক পানি বিশেষজ্ঞ মনে করে গঙ্গার মূল প্রবাহ আগে পদ্মা দিয়ে নয়, আরেক নদী ভাগীরথী-হুগলি নদীতেই যেত। ভারত নাকি ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে সেই পুরোনো ইতিহাসকে ফিরিয়ে এনেছে। যদিও এমন ধারণা নিয়ে ভিন্নমতও আছে। বাংলাদেশ-ভারত আন্তসীমান্ত নদী দিয়ে বিরোধের সূত্রপাত এই ফারাক্কা বাঁধকে ঘিরেই।
ফারাক্কা বাঁধের কারণে শুধু যে বাংলাদেশে ক্ষতি হচ্ছে বিষয়টা এমন না। এই বাঁধের কারণে ভারতের মালদহ, মুর্শিদাবাদ ও উজানে বিহার ও উত্তরপ্রদেশে আকষ্কিক বন্যা ও নদীভাঙনের কারণে প্রতিবছর বহু মানুষ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক নদীর পানি বন্টন নিয়ে জাতিসংঘের একটি কনভেনশন আছে। দ্বিপক্ষীয় বা আঞ্চলিক পানি চুক্তির ক্ষেত্রে এই কনভেনশনটিকে ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু কোনো দেশই এই আইনে স্বাক্ষর করেনি। আইনটিতে ৩৭টি ধারা আছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক আন্তসীমান্ত নদীর জন্য জাতিসংঘের দুটো সনদ রয়েছে। এসব আইনে অন্যের ক্ষতি না করে পানির যুক্তিসংগত ব্যবহারের কথা বলা আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাঁধ সংস্কার করার নজির রয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকাতে অনেক বাঁধ প্রয়োজন বুঝে সংস্থার করা হয়েছে। প্রয়োজনে আলোচনার মাধ্যমে গঙ্গার ওপর ফারাক্কা বাঁধের সংস্কার করা যেতে পারে। বাংলাদেশকে প্রতি বছর পানির ন্যায্য প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত করে ক্ষতি করা যাবে না। ন্যায়সঙ্গত সমাধান না মিললে ফারাক্কা বাঁধের কারণে আগামী বছরগুলোতেও বাংলাদেশকে ভুগতে হবে-এতে কোনো সন্দেহ নেই। মৌলিক অধিকার পানি নিয়ে ছায়াযুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। পদ্মাসহ ৫৪ টি আন্তসীমান্ত নদীর পানি নিয়ে আলোচনা করে পানির ন্যায়সঙ্গত অধিকার নিয়ে আলোচনা জরুরি। তিস্তার নদীর পানি নিয়ে স্থায়ী সমাধানের না পৌঁছানো গেলে পুরো দেশের জন্য বিপদ বয়ে আসবে। বাংলাদেশ বৈষম্য বা করুণা নয়, আন্তসীমান্ত পানি ব্যবস্থাপনায় পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার অধিকার রাখে।
লেখক: শিক্ষক, জলবায়ু ও পরিবেশকর্মী, সদস্য; বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)