Saturday 17 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উঠোন হারিয়ে বারান্দায় বন্দি সম্পর্ক

তানজিদ শুভ্র
১৭ মে ২০২৫ ১৭:০৭

এক সময় আমাদের সমাজে একান্নবর্তী পরিবার ছিল একটি শক্তিশালী সামাজিক কাঠামো। সেখানে দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, ভাই-বোনসহ একাধিক প্রজন্ম এক ছাদের নিচে বাস করতেন। রান্নাঘরে একই হাঁড়িতে সবার জন্য রান্না হতো। সন্ধ্যাবেলায় উঠোনে গল্প-আড্ডা আর পারস্পরিক স্নেহ-মমতায় গড়ে উঠতো হৃদ্যতার বন্ধন। গ্রামের সেই পারিবারিক দৃশ্যপট এখন অনেকটাই স্মৃতির পাতায় ঠাঁই নিয়েছে। তার জায়গায় এসেছে শহরের একক পরিবার, নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। যেখানে স্বামী, স্ত্রী ও সন্তান এই ক্ষুদ্র গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ সম্পর্কের চর্চা।

বিজ্ঞাপন

আমাদের জীবনের প্রথম সংগঠন আমাদের পরিবার। গ্রামীণ সমাজে একান্নবর্তী পরিবার ছিল একধরনের ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান। পরিবারে অভিভাবক ছিলেন একজন প্রবীণ পুরুষ, যিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণে ছিলেন চূড়ান্ত কর্তৃত্বের অধিকারী। তরুণ সদস্যরা জীবনের নানা দিক শেখার সুযোগ পেতেন অভিজ্ঞদের কাছ থেকে। ছোটরা শিখতো সহনশীলতা, দায়িত্ববোধ, আর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। প্রয়োজনে সবাই সবার পাশে দাঁড়াত। কোনো সদস্য অসুস্থ হলে সার্বজনীন সহযোগিতা ছিল স্বাভাবিক। ঈদ, পূজা কিংবা পারিবারিক উৎসবগুলো ছিল অনেক প্রাণবন্ত। এমন পরিবেশে মানবিক গুণাবলির বিকাশ হতো সহজেই।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু সময়ের চাকা ঘুরেছে। গ্রাম থেকে শহরে মানুষের স্রোত বেড়েছে। শিক্ষার জন্য, চাকরির জন্য কিংবা আধুনিক সুযোগ-সুবিধার আশায় মানুষ যখন শহরমুখী হয়েছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই পারিবারিক কাঠামোতেও পরিবর্তন এসেছে। শহুরে জীবনের ব্যস্ততা, স্থান সংকুলান ও ব্যক্তিস্বাধীনতার গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে তৈরি হয়েছে একক পরিবার। যেখানে বাবা-মা আর এক বা দুই সন্তানই একটি সম্পূর্ণ পরিবার।

এই একক পরিবারে স্বাধীনতা আছে, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা আছে, আছে নিজস্ব মত প্রকাশের স্বাধীনতাও। দম্পতিরা এখন নিজের মতো করে সংসার সাজান, পরিকল্পনা করেন ভবিষ্যৎ নিয়ে। সিদ্ধান্ত নিতে বাধা নেই, প্রয়োজন নেই কারও অনুমতির। সন্তানদের বড় করতে গিয়ে বাবা-মায়ের আলাদা মনোযোগ দেয়ার সুযোগ আছে, যা অনেক সময় একান্নবর্তী পরিবারে হয়তো সম্ভব হতো না।

তবে এই স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আর শহুরে গণ্ডি যে শুধুই ইতিবাচক তা বলা যায় না। আজকের একক পরিবারে নির্জনতা আছে, বিচ্ছিন্নতা আছে, আর সবচেয়ে বড় কথা আছে সম্পর্কের দুরত্ব। শহরের ফ্ল্যাট কালচারে পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে সেটাও অনেকে জানে না। ছেলেমেয়েরা বেড়ে ওঠে একঘেয়ে পরিবেশে, যেখানে দাদা-দাদির গল্প শোনার বা চাচা-চাচিদের সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ নেই। পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি ও সহনশীলতা কমে যাচ্ছে। শিশুরা শেখে না কীভাবে দলগতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয় বা মেনে চলতে হয় পারস্পরিক মূল্যবোধ।

অন্যদিকে, কর্মজীবী মা-বাবার ব্যস্ততায় সন্তানেরা বেড়ে ওঠে অনেকটা আত্মনির্ভরশীল হয়ে, কিন্তু একইসঙ্গে একাকীও। শিশুমনে তৈরি হয় এক ধরনের সংবেদনহীনতা। প্রজন্মান্তরে এই ব্যবধান বাড়তে বাড়তে আজ সামাজিক বন্ধন অনেকটাই দুর্বল।

একান্নবর্তী পরিবারে যেখানে দাদা-দাদির কাছ থেকে জীবনের বাস্তব শিক্ষা পাওয়া যেত, সেখানে একক পরিবারে সেই জায়গা দখল করে নিচ্ছে টেলিভিশন, স্মার্টফোন আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ফলে পারিবারিক নৈতিকতা ও সংস্কৃতি প্রজন্মান্তরে সংক্রমিত হওয়ার সুযোগ হারাচ্ছে।

তবে যুগের বাস্তবতা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। নগর জীবনে একান্নবর্তী পরিবার চালানো অনেকটাই অসম্ভব। আবাসন সংকট, কর্মক্ষেত্রের বিচিত্র চাহিদা, নারী-পুরুষ উভয়ের কর্মজীবী হওয়া এইসব বাস্তবতা একক পরিবারকে অনিবার্য করে তুলেছে। কাজেই সমাধান খুঁজতে হবে ব্যালান্সের জায়গায়। একক পরিবারে থেকেও কীভাবে একান্নবর্তী পরিবারের মূল মূল্যবোধগুলো ধরে রাখা যায়, সেটাই হওয়া উচিত নতুন প্রজন্মের চিন্তা।

আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা দূরত্ব কমাতে পারি। নিয়মিত ভিডিও কল, পরিবারভিত্তিক সামাজিক আড্ডা, সন্তানদের সঙ্গে দাদা-দাদির সংযোগ এসব উদ্যোগ পারিবারিক শিকড়কে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করতে পারে। আবার শহরে বসবাসকারী ভাইয়েরা চাইলে বছরে দু’বার গ্রামের বাড়িতে সবাই মিলে সমবেত হতে পারেন। এতে পারস্পরিক সম্পর্ক মজবুত হবে এবং সন্তানদের মাঝেও তৈরি হবে পারিবারিক সংস্কৃতির সংবেদন।

শিক্ষা ব্যবস্থাতেও পারিবারিক মূল্যবোধের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। বিদ্যালয় পর্যায়ে শিশুদের পারিবারিক দায়িত্ব, সম্পর্কের গুরুত্ব ও সহানুভূতির শিক্ষাদান এমন উদ্যোগ সমাজে পরিবর্তন আনতে পারে।

গ্রামের একান্নবর্তী পরিবারের ঐতিহ্য আর শহরের একক পরিবারের বাস্তবতা এই দুইয়ের মাঝে সেতুবন্ধন গড়ে তোলাই এখন সময়ের দাবি। কারণ সমাজ গঠনের মূল একক হলো পরিবার। সেই পরিবার যত সংহত, যত মানবিক, সমাজও তত সুস্থ ও স্থিতিশীল।

আমরা যদি পারিবারিক ভাঙনের এই যুগে হৃদয়ের বন্ধনকে অটুট রাখার চেষ্টায় থাকি, তাহলে হয়তো একদিন আবারও ফিরে পাওয়া যাবে সেই চেনা উঠোন, যেখানে সন্ধ্যাবেলায় সবাই মিলে গল্প করে, একসঙ্গে হেসে কেঁদে বাঁচে মানুষ।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এএসজি

তানজিদ শুভ্র মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর