দাবী এবং জনভোগান্তি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত শব্দ হিসেবে আজকাল আবির্ভূত হয়েছে। মানুষের দাবী থাকতে পারে ব্যক্তি জীবনে, পারিবারিক জীবনে এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও। সব দাবীই পূরণ হয় না। কারণ মানুষের চাহিদার কোনো শেষ নেই। অর্থনীতির সূত্রে মানুষের চাহিদা অসীম। সেই অসীম চাহিদা পূরণ করার কোনো উপায় মানুষের হাতে নেই। তবে ন্যায্যতা বলে একটা কথা আছে। যার যা পাওনা সেটা দিলে চাহিদা বা দাবী আদায়কারীর সংখ্যা কমে যায়। কারণ কোনো ন্যায্য দাবী করা মানুষের অধিকার। পরিবারের সদস্যদেরও ন্যায্য দাবী থাকে আবার রাষ্ট্রের কাছে জনগণের দাবী থাকে। মোট কথা দাবী সর্বক্ষেত্রে থাকতে পারে। জনভোগান্তি আমাদের দেশের এক নিত্য দিনকার সমস্যা। এদেশে ভোগান্তি ছাড়া দিন পার করা ইদানিং প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনি বা আমি ঠিকঠাক সময়েই রাস্তায় বের হলাম কিন্তু ঠিকঠাক সময়ে ঠিক জায়গায় পৌছাতে পারবো না। কারণ রাস্তায় বের হয়েই হয়তো আপনি আটকে যাবেন। দৌড়ে জীবনও বাঁচানো লাগতে পারে। আজ এই দাবী কাল সেই দাবী নিয়ে প্রায়ই ঢাকা শহরে বিক্ষোভ হচ্ছে। রাস্তা অবরোধ করে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকছে কেউ। ধরেই নিলাম যারা দাবী আদায়ে রাস্তায় নামছে তাদের দাবী যৌক্তিক। প্রত্যেকেরই দাবী থাকতে পারে। বঞ্চিত মানুষের সংখ্যাও কম না। কোনো উপায় না দেখেই শেষ পথ হিসেবে সব আটকে দেয়। কিন্তু রাস্তায় যে সমস্যার মুখোমুখি আমি হলাম সেটা আমার পাওনা কি না। প্রশ্নটা এখানেই। আমি কি করলাম! আমার সময়কে জিম্মি করে হয়রানি করে দাবী আদায়ের কৌশল আর কতকাল ধরে চলবে? জনহয়রানি বিষয়টা সত্যিকার অর্থে আজকাল একেবারে অন্যায্য বলেই মনে হচ্ছে। জনগণ যে নিত্য হয়রানির শিকার হবেন এটাই নিয়তি। আজ গাড়ি বন্ধ, আমার দরকার থাকলেও কোথাও যেতে পারবো না, কাল ওটা বন্ধ, তারপরদিন আরেকটা সেবাখাত বন্ধ।
দেশটা যদি জনগণের হয় তাহলে যারা নিয়মিত ভোগান্তির শিকার হচ্ছে তারা কারা? প্রতিদিন, প্রতিবেলায় আসতে যেতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। আরে বাবা রাষ্ট্রের কাছে আমি তো এসব মৌলিক অধিকার পাই। এটা থেকে বিরত রাখাও তো এক ধরনের অন্যায়ের ভিতর পরে। একটি ন্যায় করতে গিয়ে কাউকে সমস্যায় ফেলাও অন্যায়। কিন্তু কে শুনছে কার কথা! আমরা সবাই নিজের নিজের সুবিধা বুঝি। কেউ কারও দুঃখ কষ্ট ভাগ করে নিতে চাই না। ন্যায্য পাওনাই বা কেন পরিশোধ করা হবে না আবার কেন আমাকে রাস্তায় বিপদে পরতে হবে। এর উত্তর কার কাছে। এ তো আর একদিনের ঘটনা না, প্রায় প্রতিদিন হচ্ছে। শুধু রাস্তায় না এই সমস্যা আজ কোথায় নেই? হাসপাতালে যাবেন? সেখানে গিয়ে দেখবেন ধর্মঘট চলছে। আপনার যে সেবা সহজেই পাওয়ার কথা ছিল সেই সেবা আপনি পাচ্ছেন না। অথচ এটা পাওয়া আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার। কেউ এই অধিকার কেড়ে নিজের অধিকার আদায় করতে পারে না। প্রায় সব শ্রেণি পেশার মানুষ নিজের দায়িত্ব থেকে বেরিয়ে এসে দাবী আদায়ে যে কৌশল নির্ধারণ করছেন সেটা জনভোগান্তি ছাড়া আর কিছুই না। এটাও সত্য এসব ঘটনার পর তাদের দাবী আদায়ের সুরাহা হচ্ছে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? উন্নত দেশগুলিতে ঠিক এভাবে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে বা কোনো সুবিধা বন্ধ করে দাবী আদায় করার কৌশল সেভাবে চোখে পড়ে না। আমরাও তো উন্নত হচ্ছি। কাউকে বঞ্চিত করে দাবী আদায় কেন একটি কৌশলের ভিতর পরবে সেটাই প্রশ্ন।
এখন আমাদের চিন্তা ভাবনাগুলোকে একটু মর্ডানাইজেশন করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যে এই ঘটনার জেরে কতজন ক্ষতিগ্রস্থ হবে? রেলপথ অবরোধ করলে সেই রেলের যারা যাত্রী তারা সঠিক সময়ে না পৌছালে কি ক্ষতি হবে সেটা তো ভাবা দরকার। হাসপাতালে ডাক্তার বা নার্স যদি সেবা না দেয় তাহলে অসুস্থ রোগীর কি হবে সেটা মাথায় রাখা দরকার আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক যদি না পড়ান তাহলে শিক্ষার বিষয়টাও ভাবা দরকার। এসব থেকে যাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে বা হয়রানি করা হচ্ছে তাদের হয়রানি করা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক কি না সেটা চিন্তা করতে হবে। দাবী আদায়ে এবার জনভোগান্তি কৌশল বাদ দিয়ে নতুন কোনো কর্মকৌশল ঠিক করতে হবে। আমরা চাই সবার ন্যায্য দাবী পূরণ হোক। আবার এটাও চাই কেউ যেন কোনোভাবেই ভোগান্তির শিকার না হন। কারণ ভুক্তভোগী ছাড়া সেই সময় বা পরিস্থিতি কেউ অনুমান করতে পারবেন না।
লেখক: কলামিস্ট